জুবিন গাৰ্গ, যিনি কনসার্টের স্টেজে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘আমার কোনো জাতি নাই, ধর্ম নাই, ভগবান নাই, আমি কেবল একজন মানুষ’। ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম নিয়েও যিনি ব্রাম্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই জুবিনকে শেষ বিদায় জানাতে এবং তাঁর শেষযাত্রার গাড়িটি একবার ছুঁয়ে দেখতে ভারতে তার নিজ শহর আসাম রাজ্যের গুয়াহাটিতে নেমেছিল লাখো মানুষের ঢল। এই ঢল কেবল একজন শিল্পীকে ঘিরে উন্মাদনা নয়, এটি ছিল তাঁর মানবতাবাদী দর্শনের প্রতি অগণিত মানুষের নীরব সমর্থন।
জুবিন কেবল একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “অসমে চারশোরও বেশি ট্রাইব রয়েছে। এর মধ্যে বহু উপজাতির কোনো ভাষা নেই, সাইলেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে ওরা। আমি ওদের রিপ্রেজেন্ট করছি, আমি ওদের কাছে গান নিয়ে পৌঁছতে পেরেছি।” কণ্ঠের সুরের সাথে এমন গভীর জীবনবোধের মিশেল থাকলে তবেই এমনটা করা সম্ভব।
শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। তাঁর মৃত্যুতে অসমজুড়ে নেমে আসে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় শোক। গত দুদিন ধরে সব কিছু থমকে গিয়েছিল। শোকে মানুষ এতটাই বিহ্বল ছিল যে খাবার সরবরাহকারী জনপ্রিয় অ্যাপ সুইগি, জোমাটো-সহ সমস্ত অনলাইন সার্ভিস বন্ধ রাখতে হয়। কেন? কেন এমন উন্মাদনা জুবিনকে ঘিরে?

ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল। জুবিন ঠিক কী কারণে আবালবৃদ্ধবনিতার এত কাছের মানুষ ছিলেন, তা হয়তো কেউই জানে না। তাঁর মানবিকতা ছিল শর্তহীন।
জুবিন এমন একজন ছিলেন, যাঁর কফিন কাঁধে নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর গান গাইছিলেন। যাঁর মৃত্যুতে অসমের ডিজিপি নিজে রাস্তায় নেমে ভিড় সামলাচ্ছিলেন এবং পুলিশকর্মীরাও হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। বিহু উৎসবে ULFA (অসম রাজ্যে সক্রিয় একটি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন) ফতোয়া জারি করেছিল যে কেবল অহমিয়া গান চলবে, অথচ জুবিন মঞ্চে হিন্দি গানও গাইতেন—ULFA-ও তাঁকে কোনোদিন চটায়নি।


ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন বিতর্কিত, কিন্তু ভালোবাসায় ভরা। অনেক সময় সারাদিন-সারারাত মদ খেতেন, মঞ্চে উঠে গাইতেন বেসুরো গান, এমনকি বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়েও পড়তেন। তাঁর মুখে কিছু আটকাত না, অথচ সবার জন্য জুবিনের কাছে ছিল অবারিত দ্বার। মানুষ তাঁর সব দোষ ক্ষমা করে দিত। তিনি বিজেপি সরকারের CAA ও NRC বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সরকারবিরোধী বক্তব্য রাখতে কখনো পিছপা হননি।
জুবিনের মৃত্যুতে সুদূর অরুণাচল প্রদেশের অলিতে-গলিতে তাঁর ছবি সাজিয়ে মানুষ প্রার্থনা করেছেন। তাঁর কফিন একবার ছুঁয়ে দেখতে মানুষ পাগলের মতো ছুটেছেন। এই ভালোবাসা আর আবেগের কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই। জুবিন ছিলেন এক মানবিক বিপ্লবের নাম, যাঁর ভাষা ছিল কেবল ভালোবাসা।

এক নজরে শেষযাত্রা
দিল্লি থেকে আসা বিমানটি শনিবার মধ্যরাতে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়, যেখানে এক দিন আগে সিঙ্গাপুরে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সাঁতার কাটার সময় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। বিমানের লাগেজ সেকশন থেকে কফিনটি বের করে রানওয়ের পাশে রাখা হয়। সেখানে জুবিনের স্ত্রী গরিমা শইকিয়া গাৰ্গ তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং একটি অসমীয়া গামোসা রাখেন, এরপর কান্নায় ভেঙে পড়ে কফিনটি জড়িয়ে ধরেন।
পরে ফুলের মালায় সজ্জিত অ্যাম্বুলেন্সে কফিনটি রাখা হয়, যা দেখে উপস্থিত বিমানবন্দর কর্মী ও যাত্রীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিমানবন্দরের বাইরে জুবিনের গাড়িবহরটি যখন জনতার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, তখন হাজার হাজার ভক্তকে তাঁর গান গাইতে এবং ‘জয় জুবিন দা’ স্লোগান দিতে শোনা যায়।

তাঁর প্রিয় ছাদ খোলা গাড়িটি, যা তিনি কনসার্টে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন, সেটিও ছিল গাড়িবহরে। গাড়ির সামনে ছিল তাঁর বিশাল প্রতিকৃতি। তাঁর বাদ্যযন্ত্রীরাও সেই গাড়িতে ছিলেন। ভক্তরা নিজেদের মোবাইলে আইকনের শেষযাত্রা ক্যামেরাবন্দী করার জন্য ফোন উঁচু করে ধরে রেখেছিল। ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় ৩৮ হাজারেরও বেশি গান গেয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখা এই শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ গুয়াহাটিতে ছুটে এসেছিলেন।
জুবিনের মরদেহ প্রথমে তাঁর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাঠের কফিন থেকে বের করে একটি কাচের কফিনে রাখা হয়। তাঁর মুখটি দেখা যাচ্ছিল এবং বাকি অংশ একটি ‘গামোসা’ দিয়ে আবৃত করা হয়েছিল। পরে মরদেহটি অর্জুন ভোগেশ্বর বড়ুয়া স্পোর্টস কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সাধারণ মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শনিবার রাত থেকেই জড়ো হতে শুরু করে।