যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দাবি করেছেন, জনগণ ‘টাকা খেয়ে ভোট দিয়ে দেয়’। লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে আলোচনায় উপস্থাপিকার প্রশ্নে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
৫৭ মিনিটের এই সাক্ষাৎকারে উপস্থাপিকা ছাড়াও ব্রিটিশ বাঙালি এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও প্রধান উপদেষ্টাকে প্রশ্ন রাখেন। কিন্তু অনেক প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে ইউনূস নিজের মতো করে বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা যখন তার সরকারের তিনটি দায়িত্ব, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের কথা বলছিলেন। এরপর যখন সংস্কার নিয়ে তার সরকারের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরছিলেন, তখন উপস্থাপিকা প্রশ্ন রাখেন, “অনেকে তো বলছে, আপনি কেন ভোটারদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভোটাররা যে কোনো রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিক। আপনি ও আপনার সহকর্মীদের কমিশনের বদলে জনগণের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?”
জবাবে ইউনূস বলেন, “আমি যদি এটা করতে পারতাম! যদি সবাই বুঝত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, সংখ্যানুপাতিক ভোটাধিকার কী?
“অনেক জটিল বিষয় আপনি তাদেরকে বলবেন, কিন্তু তারা বলবে, ‘এসব বাদ দিন, আপনি কত টাকা দেবেন, আমি আপনাকে ভোট দেব।”
“বিষয়টা এরকম সরল হয়ে যায় যে, ‘আপনি আমাকে কিছু টাকা দিন, আমি আপনাকে ভোট দিয়ে দেব’।” বাংলাদেশে ভোটারদের নিয়ে নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।
“এভাবে ভোট করলে তো সব কিছু শেষ হয়ে যায়”, বলে মন্তব্য করে ইউনূস বলেন, “আমরা বলেছি, আমরা এভাবে ভোট করতে চাই না। ভোটাররা এই বিতর্কগুলো দেখছে। প্রতিদিনের পত্রিকায় বিতর্কগুলো আসছে।”
নতুন বাংলাদেশে তিন বিষয়
এর আগে ইউনূস ‘নতুন বাংলাদেশ’কে তিনটি বিষয় দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার কথা বলেন।
“১. সংস্কার, আমরা যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে চাই না, যেগুলো এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। আমরা সব প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করতে চাই। আমরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করার জন্য কমিশন গঠন করেছি, যাতে করে তারা গবেষণা করে আমাদেরকে সুপারিশ করে, মৌলিক কী কী পরিবর্তন আনা যায়।
“আমরা বেশ কয়েকটি কমিশন করেছি। তারা তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাদের সুপারিশগুলো দেশের ব্যাপক রূপান্তর করবে। নির্বাচন, সংসদ, সংবিধান, জনপ্রশাসন, সব কিছু।”
কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ নিয়ে আমরা একটি সর্বশেষ কমিশন করেছি, সেটি হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আপনি এই নামে কোনো কমিশনের কথা শুনেছেন? আমাদের কিন্তু আছে।
“তাদের দায়িত্ব হলো সব রাজনৈতিক দলের কাছে যাওয়া, কোন সুপারিশগুলো তারা গ্রহণ করবে, কোন সুপারিশগুলো সব দল গ্রহণ করবে? বাংলাদেশের সব দল কোনো সুপারিশে একমত হবে, এটি একটি কঠিন বিষয়।”
বিচারকে দ্বিতীয় লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “যারা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এত কিছু করেছে, তাদের হোতাদের বিচার করতে হবে।”
বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে মানুষকে প্রতিদিন গুলি করা হয়েছে। আপনার ছেলে আপনার মেয়ে বাইরে গেছে, কখনও ফিরে আসেনি। দুই বন্ধু বাইরে গেছে, তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে। ‘আমরা আর ফিরতে নাও পারি, অথবা যে কেউ একজন ফিরতে পারি’।”
প্রতিদিন মানুষ উধাও হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “কেউ জানে না কোথাও উধাও হয়েছে। তাদের জীবনে শেষে কী হয়েছে। এ রকম ভয়ংকর কাহিনির পর কাহিনি উঠে আসছে। আমরা বের করতে চাইছে এটা কারা করেছে, কার নির্দেশ ছিল এবং তাদের বিচার করা।”
উপস্থাপিকা প্রশ্ন রাখেন, “আপনি কেন পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে বিচারের ভার ছেড়ে দিচ্ছেন না? কেন এটা অন্তর্বর্তী সরকারকেই করতে হবে?”
ইউনূস বলেন, “আমি তো এই সিদ্ধান্ত নেইনি। আমাদেরকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা সেটা করছি।”
ব্রিটেনে আইন পেশায় নিয়োজিত সাইফুল্লাহ খালিদ প্রশ্ন রাখেন, “এপ্রিলের মধ্যে সব রাজনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?
জবাবে ইউনূস বলেন, “আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
নতুন সরকারে ‘না’
একজন প্রশ্ন রাখেন, “নতুন নির্বাচিত সরকার এলে আপনি সেই সরকারে অংশ হতে চান?”
জবাবে ইউনূস বলেন, “কোনোভাবেই না। আমি মনে করি আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্যই এটা করতে চাইবেন না। আমাদের দায়িত্ব হলো ট্রানজিশনটার ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করা, আমরা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেব, জনগণ যেন খুশি থাকে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই নির্বাচনটা যেন ভালো হয়। যদি নির্বাচনটা ভালো না হয়, এই সমস্যার সমাধান হবে না।“
আসল লক্ষ্য জুলাই সনদ
সরকারের ‘আসল লক্ষ্য’ তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “যেসব সুপারিশগুলো সব রাজনৈতিক দল মেনে নেবে, সেগুলো আলাদা একটি আলাদা কাগজে লিপিবদ্ধ করা এবং সেখানে সব দলগুলোর সাক্ষর নেওয়া। আমরা একে জুলাই সনদ বলছি।
“আগামী মাসে জুলাই আসছে। আমরা জনগণের উদ্দেশে এই সনদ দেব এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।”
জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট কেন নয়?
যুক্তরাজ্যে চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন প্রশ্ন রাখেন জুলাই সনদের গণভোট দেওয়া হবে কি না। তার দাবি, ৯৫ শতাংশ মানুষ এর পক্ষে আছেন।
জবাবে ইউনূস বলেন, “হ্যাঁ, এটা আমিও শুনেছি। তবে এখানে অনেক জটিলতা আছে। গণভোট আসলে অর্থহীন। কারণ, বেশিরভাগ মানুষই বুঝবে না আপনি কী জন্য ভোট দিচ্ছেন। ফলে মানুষ এ নিয়ে হাসাহাসি করবে, যে এর কোনো মানে হয় না।”
যদি সব দল একমত হয়, তাহলে গণভোটের বিষয়টি আসে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ সময় উপস্থাপিকা কিছুটা রসিকতা করে বলেন, গণভোট অনেক দেশে সমস্যার তৈরি করেছে। সে সময় সবাই হাসতে থাকেন।