জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে নিহত দেখিয়ে মামলা!


জীবিত সোলাইমান হোসেন সেলিমকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে মামলা করেছেন তাঁরই বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মস্তু ডাকাত। গত বছরের ৩০ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় সেই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৫০-২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে হইচই পড়েছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায়। পুলিশ ইতিমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে।

মামলা সূত্রে জানা যায়, মো. সোলাইমান হোসেন সেলিম (৫০) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ধামর গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে। ধামর বেলতলী বাজারে সেলিমের মুদিদোকান রয়েছে। তাঁকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে হত্যা মামলা করা হয়েছে। গত বছরের ৩ আগস্ট রাজধানীর কাজলা পেট্রল পাম্পের সামনে সেলিম গুলিতে নিহত হন দাবি করে ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মস্তু ডাকাত (৫২) ৩০ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় সাক্ষী করা হয় তাঁদের দুই সহোদর হেলাল উদ্দিন (৫৫) ও আবুল হোসেনকে (৫৪)।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে জীবিত সেলিমকে কেন নিহত দেখিয়ে মামলা করলেন তাঁরই ভাই মস্তু? ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ২০ বছর আগে তাঁদের বাবা আব্দুল হাকিম মারা যান। এরপর থেকেই ভাইদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। সেলিমের শুধু দুই কন্যাসন্তান থাকায় তাঁর ভাগের সম্পত্তিতে নজর পড়ে বাকি তিন ভাইয়ের। দুটি হত্যাসহ চারটি মামলায় জড়িয়ে নিঃস্ব মস্তু ফন্দি আঁটেন সেলিমকে নিয়ে।

এ বিষয়ে মো. সোলাইমান হোসেন সেলিম বলেন, ‘মস্তু এলাকায় চিহ্নিত ডাকাত। সে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। প্রায় ১৫ বছর ধরে বাড়িতে আসে না। কিন্তু বাকি দুই ভাইকে দিয়ে আমার সম্পত্তি গ্রাস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমার ছেলেসন্তান নেই বলে সবকিছু তাদের লিখে দিতে বলে। তাদের অত্যাচারে ধামর বেলতলি বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে বাড়ি ও দোকান করে চলেছি। বাপের ভিটায় গেলেই ঝগড়া হয়, তাই যাওয়া হয় না।’

সেলিম আরও বলেন, ‘আমাকে মামলায় তারা মৃত দেখিয়েছে, সুযোগ পেলেই মেরে ফেলত। বিষয়টি বুঝতে পেরে একটু সতর্ক হয়েছি। কিন্তু পুলিশ কেন কীভাবে একটি ভুয়া মামলা নিল? আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। পাঁচবার যাত্রাবাড়ী থানা ও ডিবি অফিসে গিয়েছি। আমি যে মরি নাই, এটা প্রমাণ করতেই বেগ পেতে হচ্ছে।’

সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলেন, সেলিমকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই নাটক সাজিয়েছেন তাঁরই তিন ভাই। এর আগেও তাঁরা সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তখন এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রাণে বাঁচেন। এ নিয়ে সেলিম ২০২২ সালে হেলাল উদ্দিন, আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেন।

বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি হওয়ায় প্রায় ১৫ বছর বাড়িতে যান না মস্তু। ঢাকায় বাস চালান তিনি।

এদিকে সেলিমকে নিহত দেখিয়ে মামলা করার বিষয়ে তাঁর ভাই হেলাল উদ্দিনের মেয়ে ঝুমি আক্তার বলেন, ‘শুনেছি মামলা হয়েছে, কিন্তু বাবাকে কেন সাক্ষী করা হলো জানি না। আমরা এই ঘটনায় দায়ী নই। মস্তু কাকা এসব করলে করতেও পারে।’

প্রতিবেশী রুহুল আমিন বলেন, ‘চার ভাইয়ের মধ্যে সেলিম নির্ভেজাল মানুষ। দোকান করে খায়। ঝামেলা এড়াতেই বাড়ি ছেড়ে বাজারে জায়গা কিনে দোকান ও বাসা করেছে। কিন্তু তার ছেলেসন্তান না থাকায় ভাইয়েরা অগ্রিম জমি-জমা নিতে চায়, যার জন্যই মূলত বিরোধ। এ নিয়ে এত বড় ষড়যন্ত্র হবে তা ভাবতেও পারিনি। একজন জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে মামলা করে ফায়দা লোটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যারা এটি করেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।’

পারিবারিক বিরোধের কারণেই জীবিত সেলিমকে মৃত দেখিয়ে তাঁর ভাই মামলা করেছেন বলে জানান ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘মস্তু এলাকায় একজন স্বীকৃত ডাকাত। তাঁর নামে দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি এবং একটি মারামারির মামলা রয়েছে। তিনি কম করে হলেও ১৫ বছর ধরে এলাকায় আসেন না। কিন্তু সেলিমের জমিজমা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা পেতেই হয়তো ভুয়া মামলাটি করেছেন।

ওসি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছি। এ বিষয়ে তারাই ব্যবস্থা নেবে।’

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে মামলার বাদী গোলাম মোস্তফা ওরফে মস্তু নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সেলিম মৃত নন, আদালতে দুই ভাইকে সামনা-সামনি করে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। মামলার তৃতীয় নম্বর তদন্ত কর্মকর্তা আমি। এই মামলায় এখন পর্যন্ত একজন আসামি গ্রেপ্তার রয়েছে। মামলাটির তদন্তকাজ আমি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় তিনি পলাতক। মামলায় তাঁর যে মোবাইল নম্বরটি দেওয়া, সেটিও বন্ধ পাচ্ছি।’

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025, Jun 15