রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি-দাওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হচ্ছে না জাতীয় পার্টি (জাপা), বরং দলটি নির্বাচনে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে দলটি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানাবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচন উপলক্ষে যেকোনো রাজনৈতিক দলেরই প্রস্তুতি থাকে। আমাদেরও একধরনের প্রস্তুতি আছে। তবে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব নির্বাচনের আগে। তখন পরিস্থিতি বুঝে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বিভিন্ন হামলা-মামলায় ভড়কে না গিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের ট্রেনেই রয়েছেন বলে জানালেন দলটির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা ভোটের ব্যাপারে সচেতন বা ওয়াকিবহাল রয়েছেন। হামলার পরে পার্টি আরও শক্তিশালী হয়েছে। দলের মধ্যে একতা আরও বেড়েছে।’
জানা গেছে, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জোর দাবি জানালেও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির তাতে সায় নেই। এ কারণে শেষ পর্যন্ত জাপাকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, শুধু জাপা কেন; কোনো রাজনৈতিক দলেরই দমন-পীড়নের পক্ষে নন তারা। জাপাকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে অন্য দলগুলোর আন্দোলনকেও বিএনপি আমলে নিচ্ছে না। এ ছাড়া বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকলে আর জাপা অংশ না নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ চাওয়া ভয়ংকর চর্চা। জাপাসংক্রান্ত আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাহী আদেশে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকে বিএনপি সমর্থন করে না। বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নির্ধারিত হতে পারে। এটা আদালত নির্ধারণ করবেন। এর জন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। এই আইন আগে ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘আইন সংশোধনের পর এখন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যেকোনো দলের বিরুদ্ধে আদালত ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আদালত সিদ্ধান্ত নিলে নির্বাচন কমিশন মানতে বাধ্য। এই প্রক্রিয়ার বাইরে অন্য কোনো প্রক্রিয়াকে বিএনপি সমর্থন করে না।’
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘২০২৪ সালের নির্বাচনে ২৮টি দল অংশগ্রহণ করেছে। তাদেরও দোসর হিসেবে নিষিদ্ধ করতে চাইলে নির্বাচনটা কাদের নিয়ে হবে? নিজেদের অতিরিক্ত সুবিধার জন্য আরও অনেক দলের নিষিদ্ধ চাইতে পারে কেউ। তবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি অন্য কোনো দলের বিরুদ্ধে যদি একই অভিযোগ থাকে, সেটা আদালতে উত্থাপন করা যেতে পারে।’
সূত্র জানায়, জাপাকে ভাঙার প্রশ্নে কিছুদিন আগ পর্যন্ত ‘পর্দার আড়ালে’ নানা অপতৎপরতা জোরদার থাকলেও বিএনপির তাতে সায় না থাকায় এই দাবিটি দুর্বল হয়ে যায়। জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন অংশ এখন নিজেদের মধ্যে কিছুদিন পরপর ঘরোয়া বৈঠক করলেও জাতীয় রাজনীতিতে এর তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না।
তবে এমনই এক ঘরোয়া বৈঠকে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামী কীভাবে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে, সেই প্রশ্ন তোলেন। তিনি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিকে অনভিপ্রেত, অগণতান্ত্রিক এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বিপজ্জনক আখ্যায়িত করে বলেন, যে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে জাতীয় পার্টি অতীতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল, সেই জামায়াত কীভাবে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে? বিষয়টি বিস্ময়কর ও দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জানা গেছে, দল ভাঙার প্রশ্নে বিএনপির সম্মতি না থাকা এবং জি এম কাদেরের শক্ত অবস্থানের কারণে তার নেতৃত্বে আপাতত ঐক্যবদ্ধই থাকছে জাপা।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, দল ভাঙার অপতৎপরতা শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। এক-এগারোর সরকার, বিগত আওয়ামী লীগ এবং তার আগে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ও দল ভাঙার রাজনৈতিক চর্চা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপির প্রায় শতাধিক নেতাকে টোপ দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই চেষ্টা বড় ধরনের সফলতা পায়নি। দল ভাঙার অপতৎপরতায় খুব বেশি লাভবান হওয়া যায় না বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে।
সম্প্রতি কয়েক দফায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, যারা ভোটের আগে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, সেই অপশক্তি এখন জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। তারাই জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা, অগ্নিসংযোগ করেছে।
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মহাজোট সঙ্গী হিসেবে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে সংসদে বিরোধী দলে বসায় জাপাকে নিয়ে দেশের রাজনীতিতে সমালোচনা আছে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলই জাপাকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ তকমাও দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তখন দলটির ভূমিকা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। যদিও জি এম কাদের নির্বাচনের আগে থেকেই শেখ হাসিনা এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আসছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি বলেছেন, গানপয়েন্টে তাকে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আগে বিরোধী দলের নেতা হিসেবেও জাতীয় সংসদ অধিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সভা-সেমিনার এবং বিবৃতিতে ছাত্রদের দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দলের সিনিয়র নেতা ও সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যেতে বাধ্য হন তিনি। সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলটির ভাগ্যে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা জোটে। দলটির একজন সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরে তাদের জেলেও পাঠানো হয়েছে। এসব ঘটনায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়নের অভিযোগও এনেছেন।
জাপার মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘নির্বাচন উপলক্ষে এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়নি। নির্বাচনের আয়োজন করতে গেলে যে ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তা দরকার, সেসব কিছুর আলামত এখনো দেখছি না।’
জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশের মদদ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
তিনি বলেন, ‘একদিকে ভোটের কথা বলবেন, অন্যদিকে আমাদের পার্টিকে ব্যান (নিষিদ্ধ) করার কথা বলবেন, তাহলে নির্বাচন আর অংশগ্রহণমূলক থাকল কোথায়? আমরা তাই মনে করি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারকে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলার ঘটনা রুখে দিতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকার বেকায়দায় পড়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন জাপা মহাসচিব। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি এখন তাদের ভোট ব্যাংক নিয়ে চিন্তা করছে।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘যারা আমাদের পার্টি ব্যান করার কথা বলছে, তারা কেউ আমাদের ভোটার না। আমরা ভাবছি, আমাদের ভোটার এবং কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে। সমর্থকদের আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা ভোটে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
জাতীয় পার্টিকে ভোটের মাঠে বাধা দেওয়া হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করেন জাপা মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘কেউ আমাদের বেআইনিভাবে অ্যাটাক করলে, বাধা দিলে, নিশ্চিতভাবে সেটা সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের নিদর্শন হবে না। সরকারকে তাই নিশ্চিত করতে হবে যেন ভোটের মাঠে আমাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ না হয়।’
সূত্র : খবরের কাগজ