জাতিসংঘের ঘোষণা : দুর্ভিক্ষের কবলে গাজা

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ‘মানবসৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। গাজার অন্তত পাঁচ লাখের বেশি বাসিন্দা চরম খাদ্যাভাবে ভুগছেন। প্রতিদিনই দুর্ভিক্ষে মৃত্যু বাড়ছে। মৃতের একটা বড় অংশ শিশু। অনেক শিশু খাদ্যাভাবে এতটাই দুর্বল, কাঁদতে বা খাবার খেতে পারছে না। জাতিসংঘের চার সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, এক্ষুনি পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

শুক্রবার খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক এক প্রতিবেদনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলার প্রধান লক্ষ্যস্থল গাজা সিটিসহ কয়েকটি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এ দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি মানবসৃষ্ট। এটা থামানো ও স্বাভাবিকের দিকে নেওয়া সম্ভব।’ এতে বলা হয়, ‘বিতর্ক ও দ্বিধার সময় শেষ হয়ে গেছে। অনাহার এখন বাস্তবতা, যা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয় যে, দ্রুত একটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’ মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিল।

প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি), যা নিজ নিজ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের চার সংস্থা– এফএও, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি ও ডব্লিউএইচও। প্রায় দুই বছর ধরে চলমান যুদ্ধে গাজায় বারবার খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে ইসরায়েল। এ পরিস্থিতিতে উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধ দ্রুত স্থায়ীভাবে বন্ধের দাবি জানিয়েছে সংস্থাগুলো। এতে অভুক্তদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া ও বড় পরিসরে মানবিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছে।

সাম্প্রতিক বিশ্বে আর কোথাও ত্রাণ আটকে কোনো জনগোষ্ঠীকে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা দেখা যায়নি। গাজা সিটিতে ইসরায়েলের পূর্ণমাত্রার হামলার প্রথম ধাপ শুরুর এক দিন পরই জাতিসংঘ এ ঘোষণা দিল। ওই হামলা ও অবরোধের কারণে ১০ লাখ বাসিন্দার নগরীতে বড় ধরনের প্রাণহানির শঙ্কা বেড়েছে। বৈশ্বিক সংস্থা মেডিয়েশন গ্রুপ ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক মার্টিন গ্রিফিথস আলজাজিরাকে বলেন, গাজা বিষয়ে বিশ্ব খুব ধীরগতিতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। এসব সরকার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তবে তাদের স্পষ্ট কোনো কার্যক্রম নেই।

গাজার বাইরে জর্ডান ও মিসর সীমান্তে ২২ হাজারের বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অপেক্ষায় থাকলেও অনুমতি দিচ্ছে না ইসরায়েল। এ অবস্থায় সীমিত আকারে কিছু ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়ে ত্রাণ বিতরণের নামে গাজায় এক ভয়ানক খেলা চলছে। জাতিসংঘের বারণ সত্ত্বেও এ বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র সংগঠন জিএইচএফ। তারা কাউকে পছন্দ না হলেই গুলি করে হত্যা করছে– সে শিশু হোক, বা বৃদ্ধ; চিকিৎসক বা অন্য কোনো পেশার মানুষ। গত ২৭ মের পর থেকে দুই হাজারের বেশি ত্রাণপ্রত্যাশীকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ধরনের হত্যার জেরে গাজাজুড়ে ত্রাণ বিতরণ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ ত্রাণ সরবরাহের বাইরে থেকে গেছেন। এতে অনাহারে মৃত্যু বেড়েছে। গাজা সিটিসহ উত্তর গাজায় প্রতিদিনই দুর্ভিক্ষে প্রাণহানি ঘটছে। গতকাল শুক্রবার এক দিনে দুর্ভিক্ষে আরও দুজন মারা গেছেন। এবার জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা এলো। এতে রাতারাতি ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে বা হামলা বন্ধ করে দেবে– এমনটা মনে করা কঠিন। তবে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে।

সিএনএন জানায়, গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। গত মাসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও স্বীকার করেন, গাজায় আসলেই অনাহার-অভুক্তের ঘটনা ঘটছে। নেতানিয়াহু বলেছিলেন, সেখানে কেউ অনাহারে নেই।

জাতিসংঘ দুর্ভিক্ষ ঘোষণার পর এ নিয়ে মুখ খুলেছেন মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। শুক্রবার সামাজিক মাধ্যম এক্সে তিনি বলেন, ‘গাজায় যে দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা মানবসৃষ্ট। এটা নৈতিকতার পতন ও মানবতার ব্যর্থতা।’ গুতেরেস বলেন, ‘দখলদার শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গাজার মানুষের জন্য খাদ্য, চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে ইসরায়েলের। আমরা ক্ষমাসুলভ মনোভাব নিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে দিতে পারি না। কোনো অজুহাত মেনে নেওয়া হবে না।’

এর আগেও ইসরায়েলকে কঠোর বার্তা দিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু তারা তা আমলে নেয়নি। গাজা সিটিতে নতুন করে সামরিক অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন দেশ চাপ দিলেও তা শোনেনি নেতানিয়াহু প্রশাসন। এ নিয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের দূরত্ব বেড়েছে।

গত মাসে সিএনএন এক প্রতিবেদনে গাজায় চার বছরের শিশু রেজওয়ান আবু জাহেরের অনাহারে মৃত্যুর বৃত্তান্ত তুলে ধরে। মারা যাওয়ার পর তার কঙ্কালসার দেহ পড়ে ছিল ইট-পাথরের পাটাতনে। গত বৃহস্পতিবার অভুক্ত থেকে আরও দুজন মারা যান, তখন ক্ষুধায় মৃত্যু ২৭১ জনে পৌঁছে। গত ২৭ মে জিএইচএফ নামের সশস্ত্র সংগঠন ত্রাণ বিতরণ শুরুর পর থেকে এ সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। আইপিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বয়সী এক লাখ ৩২ হাজার শিশু অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৪১ শিশুর অবস্থা শোচনীয়।

যুদ্ধ বন্ধের দাবি সংস্থাপ্রধানদের

ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন বলেন, কয়েক মাস ধরেই দুর্ভিক্ষ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। যুদ্ধবিরতি দিয়ে পূর্ণ মানবিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথারিন রাসেল বলেন, গাজায় দুর্ভিক্ষ এখন রূঢ় বাস্তবতা। অনেক শিশু এতটাই দুর্বল, কাঁদতে বা খেতেও পারে না। শিশুরা ক্ষুধা ও রোগশোকে মারা যাচ্ছে। দ্রুত যুদ্ধবিরতি না হলে তাদের বাঁচানো যাবে না। ডব্লিউএইচওর পরিচালক ড. টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেন, ‘বিশ্ব অনেক দেখেছে। মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু ঘটছে। একটি যুদ্ধবিরতি নৈতিক কারণেও প্রয়োজন।’

যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ বন্ধ চায় চার সংস্থা

ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ বন্ধ চায় জাতিসংঘের চার সংস্থা। গাজা সিটিতে ইসরায়েলের হামলা বাড়ানো নিয়েও এসব সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি থাকায় সেখানে মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাগুলো। বিশেষ করে অসুস্থ, অপুষ্ট শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও শারীরিক প্রতিবন্ধীরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারবেন না। তারা হামলার বড় ভুক্তভোগী হবেন।

ভুক্তভোগী শিশু ও নারীরা

গাজায় অপুষ্টি বাড়ছে বিপর্যয়কর হারে। কেবল গত জুলাই মাসে ১২ হাজারের বেশি শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। সেই সঙ্গে প্রসূতি ও বুকের দুধ দেওয়া নারীদের মধ্যে অপুষ্টি বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে যেসব শিশুর জন্ম হচ্ছে, তাদের ওজন কম বা অপুষ্ট। এ অবস্থায় বাইরে থেকে আসা ত্রাণ ছাড়া গাজার মানুষের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। উপত্যকার ৯৮ শতাংশ ফসলি জমি ধ্বংস হয়ে গেছে।

বিরল ঘোষণা

আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা অনেকটাই বিরল। ২০১১ সালে আইপিসি সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করে। ২০১৭ ও ২০২০ সালে দক্ষিণ সুদান এবং গত বছর সুদানের পশ্চিম দারফুরের বিভিন্ন অংশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যে এটাই প্রথম।

এক দিনে আরও ৭১ জন নিহত

ক্ষুধায় মানুষ মারার পাশাপাশি গাজায় বোমা ও গুলিতে হত্যা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। গতকাল শুক্রবার এক দিনে সেখানে আরও ৭১ জন নিহত হয়েছেন। মোট নিহতের সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত দেড় লাখের বেশি।

Tags :

International News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025