কেন জামায়াতের আমির জনসভায় অজ্ঞান হলেন? সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ

গতকাল বিশাল জনসমাবেশে আমরা জামায়াতের আমিরকে আকস্মিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কি আসলেই অসুস্থ ছিলেন নাকি এটি জনসাধারণের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায়ের একটি অবচেতন কৌশল? আসলে জামায়াত এমন একটি দল যারা বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, তাদের ডেমোনাইজ করা হয়েছিল, যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এদেশের মাটিতে তারা কখনো স্বাধীনভাবে এত বড় পরিসরে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি।

আমরা যখন একজন অসহায়
মানুষের কষ্ট দেখি,
আমাদের মিরর নিউরন লাইটআপ হয়,
অক্সিটোসিন নিঃস্বরণ হয় এবং আমরা
তাদের মুভমেন্টের সাথে কানেকশন অনুভব করি


এখনো জামায়াতকে এদেশের মানুষ ডেঞ্জার ও থ্রেট হিসেবে দেখে। এজন্য জামায়াতের আমিরের মস্তিষ্কে “Subconscious Sympathy Reflex” নামক একটি কন্ডিশন তৈরি হয়েছে। এটি মানুষের মধ্যে তখনই তৈরি হয় যখন তারা প্রচণ্ড স্ট্রেস, কন্ট্রোভার্সিয়াল সিচুয়েশন ও রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘদিন কোণঠাসা অবস্থানে থাকেন। এ সিগন্যালের মাধ্যমে তিনি জনগণের কাছে মেসেজ দিয়েছেন, আমরা নমনীয়, দুর্বল, অবহেলিত, অসুস্থ, নির্যাতিত ও কোনঠাসা: আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়ান

তিনি কোনোপ্রকার শব্দ না করেই, এক বিশাল মানবিক ও পলিটিক্যাল মেসেজ দিলেন। তার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য বন্ধু ও শত্রু নির্বিশেষে সবাইকে কষ্ট দেবে। সবাই সিম্প্যাথি অনুভব করবে কারণ তার এ আচরণ খুবই নিস্পাপ, অসহায় ও শিশুসূলভ ছিল, যেন একজন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তি তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে জনগণকে উদার্থ আহ্বান করছেন, প্লিজ আমাদের একটাবার সুযোগ দিন!

একজন বিতর্কিত নেতার পক্ষে,
বিশেষ করে যখন তিনি কঠিন
প্রশ্নের মুখোমুখি বা বিচারাধীন
চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন,
তখন এমন একটি নাটকীয়তা
(ইচ্ছাকৃত বা প্ররোচিত)
অনেক সময় কার্যকর হতে পারে।"

আবার এটি হতে পারে একটি কৌশলগত নাটকীয়তা, যেটাকে বলে “Strategic Sympathy Stunt”। ইতিহাসে এমন বহু ঘটনা আছে যেখানে পলিটিশিয়ানরা অসুস্থতা, কান্না, দুর্বলতা, বা “হঠাৎ বিপদে পড়া” নাটক ব্যবহার করেছেন জনসমর্থন বাড়াতে বা মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনতে।

১৯৯৬ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বোরিস ইয়েলতসিন ছিলেন একদম অজনপ্রিয়। দুর্নীতি, অসুস্থতা আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে রাজনৈতিকভাবে তিনি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। চূড়ান্ত নির্বাচনের আগে তিনি হঠাৎ নির্বাচনী প্রচার বন্ধ করে দেন—কারণ, “তার হৃদরোগ খারাপের দিকে”, তিনি মৃত্যুর মুখে। পুরো দেশ জেনে গেল, প্রেসিডেন্ট মৃত্যুপথযাত্রী। মিডিয়ায় খবর: ইয়েলতসিন জীবিত থাকবেন কি না, সেটা অনিশ্চিত। নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি হঠাৎ ফিরে এলেন এক বিশাল মিছিল নিয়ে—মাথায় ব্যান্ডেজ, গলায় কষ্টকর কণ্ঠ, কাঁপা হাতে বক্তব্য—“আমি দেশের জন্য মরতেও রাজি”

আবার জার্মান সামরিক কর্মকর্তারা হিটলারের বিরুদ্ধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই এক বোমা হামলার চেষ্টা করেন (Operation Valkyrie)। বোমা বিস্ফোরণের সময় হিটলার আহত হন—হাত পুড়ে যায়, প্যান্ট ছিঁড়ে যায়, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। তিনি তৎক্ষণাৎ ক্যামেরার সামনে এসে ব্যান্ডেজ লাগানো হাত, পুড়ে যাওয়া ইউনিফর্ম পরে, কাঁপা কণ্ঠে ভাষণ দেন: “এই আঘাত প্রমাণ করে, আমি ঈশ্বরের আশীর্বাদে বেঁচে আছি। আমি জার্মানির নিয়তি।” প্রচুর সাধারণ মানুষ হিটলারের প্রতি নতুন করে ঈশ্বরিক শ্রদ্ধা আর আবেগে ভাসে—একজন মুক্তি-প্রার্থী মহানায়ক হিসেবে।

আমরা যখন একজন অসহায় মানুষের কষ্ট দেখি, আমাদের মিরর নিউরন লাইটআপ হয়, অক্সিটোসিন নিঃস্বরণ হয় এবং আমরা তাদের মুভমেন্টের সাথে কানেকশন অনুভব করি। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যখন মঞ্চ থেকে পড়ে গিয়েছিল, আমরা রিওয়ার্ড পেয়েছিলাম, আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, এটা খুবই কৌতুকপূর্ণ। কারণ একজন দুষ্টলোকের আকস্মিক ছিটকে পড়ে যাওয়া দেখে মানুষ আনন্দিত হয় (আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না তিনি দুষ্ট লোক)।

একজন বিতর্কিত নেতার পক্ষে, বিশেষ করে যখন তিনি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি বা বিচারাধীন চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন, তখন এমন একটি নাটকীয়তা (ইচ্ছাকৃত বা প্ররোচিত) অনেক সময় কার্যকর হতে পারে। এমনটা হলে এটি হবে “planned psychological inversion”—যেখানে নিজেকে দুর্বল দেখিয়ে জনগণকে অনুকম্পায় টেনে আনা হয়। ইসলামপন্থী বা রক্ষণশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বেলায় দেখা যায় যে তারা শহীদ-সুলভ দুর্ভোগ বা নিপীড়িত ইমেজ তৈরি করে জনতার আবেগ কাজে লাগান। পড়ে যাওয়া, কষ্ট করে উঠা, তারপর বক্তৃতা চালানো — এটি একধরনের “মুজাহিদ” ইমেজ তৈরি করতে পারে: যে অসুস্থতা ও কষ্ট সত্ত্বেও ইসলাম বা জনগণের পক্ষে কথা বলতে তিনি পিছপা হন না।

তবে নিশ্চিত করে বলা যায় না যে তার আকস্মিক পড়ে যাওয়ার পেছনে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট জড়িত, পাবলিক সিম্প্যাথি জড়িত নাকি এটা তার অতীতের ট্রমার আকস্মিক বিস্ফোরণ, অথবা সামগ্রিক প্রেক্ষাপট আয়োজন করতে গিয়ে তিনি শারীরীকভাবে অসুস্থ ও বিপর্যস্ত

আমরা আনুমানিক এটা বলতে পারি, একজন রাজনৈতিক নেতা সাবকনশাসলি অথবা কনশাসলি এ ধরনের রিয়্যাকশন করতে পারেন যখন তিনি বোঝেন তিনি বিতর্কিত অবস্থানে আছেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছেন অথবা জনমত তার বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে অপোসাম আরও কিছু প্রাণী আছে যারা আকস্মিক শত্রুর সামনে পড়ে গিয়ে নিজেকে মৃত হিসেবে উপস্থাপন করে। এরা হঠাৎ এক জায়গায় স্থির হয়ে যায়, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে, এবং এমনভাবে পড়ে থাকে যেন মৃত্যু হয়েছে। এটা ১০০% অবচেতন, স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া—কিন্তু শিকারীকে বিভ্রান্ত করতে অত্যন্ত কার্যকর।

অনেক ছোট প্রাণী (যেমন বিড়ালছানা, কুকুরছানা, বানর, এমনকি শিম্পাঞ্জি) বিপদে পড়লে বা হুমকির মুখে পড়লে তারা সাবমিশন পোজ নেয়—গলা বা পেট উন্মুক্ত করে দেয়, করুণা জাগানোর মতো শব্দ করে।

এটা তাদের parental বা social protection instinct ট্রিগার করে। শিম্পাঞ্জি কখনো মারামারিতে দুর্বল হয়ে গেলে করুণা জাগানোর জন্য মুখ কুঁচকে ফেলে বা ছোট বাচ্চাদের মতো আওয়াজ করে যাতে গোষ্ঠীর অন্যরা তাকে রক্ষা করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। হাতি কখনো আহত হলে, তা লুকানোর চেষ্টা করে, আবার কেউ তাকে সাহায্য করলে করুণা জাগানো আচরণ করে—যা social bonding তৈরি করে। এটা হলো এক ধরনের evolutionary neurobehavioral defense mechanism, যেখানে প্রাণী (বা মানুষ) সাবকনশাসলি দুর্বলতা দেখিয়ে সহানুভূতি, নিরাপত্তা বা সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করে। একে বলে “Adaptive Appeasement Response” বা “Strategic Vulnerability Reflex”

আমি জানি, জামায়াতের আমির একজন সেনসেটিভ ক্যারেক্টার। একজন রেসপেক্টেড ফিগারের অসুস্থতা নিয়ে ক্রিটিক্যাল এনালায়সিস করা বিপজ্জনক। আর এটাই জামায়াতের আমিরের সফলতা, যে এখন তাদের নিয়ে কেউ ক্রিটিক্যাল এনালায়সিস করলেও, তারা গণমানুষের সিম্প্যাথি পাবে। মানুষ তাদের প্রতি সহনশীল ও মানবিক হবে, যেমনটি আমার আজকের লেখায় তাদের সম্পর্কে একটি সফট ও নিউট্রাল টোন ছিল।

Tags :

Leehon Prime

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025