বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামি ও এর ছাত্রসংগঠন শিবিরসহ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী সংগঠনের উত্থান কোনো একক কারণে হয়নি। এটি এক জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে আভ্যন্তরীণ (দেশীয়) ও আন্তর্জাতিক (বৈশ্বিক) — দুই ধরনের ফ্যাক্টরই ভূমিকা রেখেছে। তবে, প্রধান ভূমিকা রয়েছে বৈশ্বিক কুশীলবদের, ভু-রাজনীতির।
(১) আভ্যন্তরীণ কারণগুলো হচ্ছে:
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিভাজন ও বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা (বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণে), এবং দেশ ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। এই প্রেক্ষিত মনে রাখতে হবে।
১৯৭৫ সালের শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সামরিক শাসনের (জিয়া ও এরশাদ আমল) সময় ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে ধর্মকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থানের সুযোগ তৈরি হয়। শুরু হয় জামায়াতের বৈধতা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বৈধ করেন। এর ফলে নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠিত হয়ে সংগঠিতভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক জোটে অংশ নিয়ে তারা মূলধারার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
এরপর শুরু হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন দখল করা। ছাত্র শিবির বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে সংগঠিতভাবে বিস্তার ঘটায়। মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তার ও পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের অভাবও চরমপন্থী চিন্তার জন্ম দেয়। বিশেষ করে কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার কিছু অংশ জামায়াতি চিন্তাধারার প্রভাবে পড়ে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নটি রাজনীতি থেকে আড়াল হয়ে যাওয়ায়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্ব বা বন্ধ হয়ে যাওয়া দীর্ঘদিন সমাজে নৈতিক অস্পষ্টতা তৈরি করে। এতে জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলি নিজেদের “বৈধ রাজনৈতিক শক্তি” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বাংলাদেশে ক্রোনি পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে, বিশ্বায়নের প্রভাবে। শুরু হয় নয়া উদারবাদী ‘অবকাঠামো নির্মাণ’ উন্নয়ন, যা মানবিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে রুদ্ধ করে। এর ফলে তৈরি হয় অর্থনৈতিক অসন্তুষ্টি, বেকারত্ব ও সাংস্কৃতিক শূন্যতা।
যুবকদের মধ্যে হতাশা, সামাজিক বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের অভাব জঙ্গিবাদী মতাদর্শে আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে।

(২) আন্তর্জাতিক কারণ; পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ও সাম্রাজ্যবাদী ভু-রাজনিতি
ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গিবাদের উত্থান সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিরোধী ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ থেকে। ১৯৮০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সোভিয়েত বিরোধী আফগান জিহাদে ‘ইসলামি’ গোষ্ঠীগুলিকে কাজে লাগায়। এতে বাংলাদেশ থেকে শিবিরের কর্মীরা আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়, ফিরে এসে তারা চরমপন্থী সংগঠন গঠনে ভূমিকা রাখে (যেমন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী)।
বিশ্বায়নের অভিঘাতে ব্যাপক শ্রমিক অভিবাসন ঘটে মধ্যপ্রাচ্যে। মার্কিন মদদে সৌদি আরবসহ কিছু মধ্যপ্রাচ্যের দেশে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাধ্যমে ওয়াহাবি ও সালাফি মতাদর্শ দেশে প্রবেশ করে। তৈরি হয় এনজিও, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এবং এই সকল প্রতিষ্ঠা ও মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থায়নের মাধ্যমে ধর্মীয় র্যাডিকাল ভাবধারার বিস্তার ঘটে।
ইউরোপ আমেরিকায় একধরনের ‘ইসলাম’ ভীতি তৈরি হয় টুইন টাওয়ার হামলা ও সাম্রাজ্যবাদী ‘ওয়ার অন্ টেরর’ এর অন্যায় যুদ্ধের ফলে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়, তা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রসারে ভূমিকা রাখে। জঙ্গি সংগঠনগুলো এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় “জিহাদের” ডাক দেয়, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে।
জামাত -শিবির আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে ওঠে। আল-কায়েদা ও পরবর্তীতে আইএস-এর অনলাইন প্রচারণা ও আর্থিক সহায়তা বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে (যেমন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি ইত্যাদি) শক্তিশালী করে।

মূলত জামাত শিবিরের রাজনৈতিক কার্যক্রম সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক – একটি সমন্বিত রূপ পায়, যা গড়ে ওঠে সিআইএ ও পাকিস্থানি আইএসআইএর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, ভু-রাজনৈতিক কৌশলগত যুদ্ধের লক্ষ্যে।
পরিশেষে, আমরা দেখি, ২০২৪ সালের কালার রেভোলিউশন ও জামাতের ক্ষমতা, এবং বর্তমান ‘আঙ্গুল বাঁকা করে ঘি খাওয়ার’ ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্যের পেছনে একটি বাস্তব কারণ আছে, এদের সামরিক শাখা বা জঙ্গি সংগঠন এর সশস্ত্র ক্যাডাররা, যা আর কোন রাজনৈতিক দলের নেই।




