ইসলামী জঙ্গীবাদ ও মাইক্রো ক্রেডিড কি আমেরিকার সৃষ্টি?

যদি বলি ইসলামী জঙ্গীবাদ ও মাইক্রো ক্রেডিড আমেরিকার সৃষ্টি? শুনলে বিস্ময়কর মনে হলেও অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধারণাটি সমর্থন করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে, কেন? কেন আমারিকার মতো একটি রাষ্ট্র ইসলামী মৌলবাদ প্রসারের জন্য কাজ করবে? আসলে আমেরিকা সমগ্র বিশ্বে ইসলামী মৌলবাদ বিস্তার করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে অবদমনের উদ্দেশ্যে। কারণ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল সম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বোমা।

১৯৮০ সালে যখন সমগ্র বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন তারা ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে আফগান মুজাহিদিন তৈরি করে, যেখান থেকে পরবর্তীতে জন্ম নেয় আল কায়দা ও তালিবান। এ পরিকল্পনা সফল করতে সাহায্য করেছিল আমেরিকান CIA এবং সৌদি ISA। শুধু তাই নয়, সে সময় আমেরিকা সৌভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানোর জন্য ইরানের মোহাম্মদ শাহ পাহলভিকে অপসারণ করে এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির হাতে ইরানের শাসন ক্ষমতা অর্পন করে। তারা সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের বুঝিয়েছিল, কমিউনিস্টরা নাস্তিক, তারা যদি বিশ্বের ক্ষমতা পায়, তবে ইসলাম ধর্মের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না

১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিবিগনিউ ব্রজনস্ক্লি বলেছিলেন, আমরা যদি সৌভিয়েত ইউনিয়নকে অবদমন করতে চাই, তবে আমাদের মুসলিমদের সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ হিসেবে বলেন, এটি এমন এক ধর্ম যার ইমিউনিটি খুবই স্ট্রং এবং এটি খুবই উচ্চমাত্রিকভাবে রিয়্যাক্টিভ। একমাত্র মুসলিমরাই ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য লাখ লাখ মানুষ হত্যা করতে পারে এবং প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারে। এরা এমন এক ভাইরাস, আমরা যদি সুপরিকল্পিতভাবে এই ভাইরাস সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে সৌভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিশ্চিত। এটাকে বলা হয় গ্রিন বেল্ট থিওরি। এ থিওরির মূল কথা ছিল, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চারপাশে একটি বেল্ট বা দেয়াল তৈরি করতে হবে।

আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমাদের বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের তুলনায় এখন ধর্মীয় মৌলবাদের আধিপত্য সর্বাধিক। স্ক্রিনওয়ার্ল্ড এদেশের মানুষকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শন দেয়নি, এটি আমাদের দিয়েছে ধর্মীয় রক্ষনশীলতা, উগ্রতা ও পশ্চাতপদতা! কিন্তু কেন? এর পেছনে কারণ ফেসবুক ও ইউটিউব এলগোরিদম

ফেসবুক ও ইউটিউব এলগোরিদম এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন এটি সে সকল কন্টেন্টকে প্রমোট করে, যেখানে এনগেজমেন্ট সর্বাধিক। এভাবে এলগোরিদম তার রেভিনিউ বৃদ্ধির জন্য সবসময় ইমোশনাল ও এনগেজিং কন্টেন্ট প্রমোট করেছে, আর এভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ গড ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। গড ভাইরাস সংক্রমণের পর তারা সাইবার জেহাদ ঘোষণা করে। মুক্তমনা ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের আইডি ও ওয়েবসাইট হ্যাক ও রিপোর্ট করতে শুরু করে। একদিকে ফেসবুক এলগোরিদম বুদ্ধিবৃত্তিক কন্টেন্টকে লাভজনক মনে করে না আর অন্যদিকে সাইবার জেহাদিরা বুদ্ধিবৃদ্ধিক কন্টেন্টকে তাদের অস্তিত্বের জন্য থ্রেট মনে করতে শুরু করে।

এলগোরিদম ও সাইবার যোদ্ধারা যখন মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে একযোগে যুদ্ধ করছিল, তখন সেখানে যোগদান করেছিল শেখ হাসিনা ও প্রফেসর ইউনূসের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যারা বিভিন্ন প্রকার অবদমন ও নিপীড়নমূলক আইন প্রণোয়ন ও এলগোরিদমকে বুস্ট করে, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির জগতকে চিরকালে অবরুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল। মুক্তচিন্তকরা একটা সময় বুঝতে পারে, যুক্তি ও বিজ্ঞানে এদেশে কোনো রিওয়ার্ড নেই আর তাই তারা যুক্তি ও বিজ্ঞান ছেড়ে সমালোচনা, ট্রল, হ্যারাসমেন্ট ও নেগেটিভ কন্টেন্ট লিখতে শুরু করে। তারা তাদের আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে যায়। এলগোরিদম চেয়েছিল ডলার, সাইবার যোদ্ধা চেয়েছিল স্বর্গ, সরকার চেয়েছিল পপুলারিটি ও ডিজিটাল যোদ্ধাদের উপর নিয়ন্ত্রণ। আর আমেরিকা চেয়েছিল একদল আনইন্টেলেকচুয়াল ধর্মান্ধ যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ধরে রাখা যায়।

বিশ্বের মানুষ ধর্মান্ধ হলে আমারিকার একটাই উপকার আর তা হলো, তারা কখনো সিস্টেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, তাদের খুব সহজে ম্যানিপুলেট করে কালার রেভোল্যুশন ঘটানো সম্ভব। বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ যদি ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারে এনগেজড থাকে, তবে তারা কখনো লিডার হতে পারবে না, তারা কখনো প্রযুক্তিকে কন্ট্রোল করতে পারবে না, বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষ, সুনির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠী আর অন্যরা হবে তাদের টিকে থাকার উদ্দেশ্য তৈরি এক একটি রোবট।

১৯৭০–৮০’র দশকে যখন আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার জোয়ার চলছিল, তখন বিশ্বব্যাংক, IMF এবং পশ্চিমা দেশগুলো বুঝেছিল যে এই ঢেউ অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে দিতে পারে। ঠিক তখনই রবার্ট ম্যাকনামারা (বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ইউএস ডিফেন্স সেক্রেটারি) ক্ষুদ্র ঋণের ধারণাকে আক্রমণাত্মকভাবে ছড়িয়ে দিতে থাকেন

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার পেছনে পশ্চিমা অর্থায়ন ও প্রশংসা ছিল। তাদের যুক্তি ছিল, গ্রিন বেল্ট বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙা সম্ভব নয়—বরং দরিদ্র জনগণকে ছোট ঋণের মাধ্যমে “উদ্যোক্তা” বানিয়ে সিস্টেমের মধ্যেই রাখো। এতে তারা যতোই চেষ্টা করুক, মূল কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। মাইক্রোক্রেডিট ব্যাবসায় গরিব মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, একদিকে যেমন ছোট ব্যবসার স্বপ্নে জড়ায়, অন্যদিকে ঋণের চক্রে আটকে যায়—তাদের মধ্যে আর সংগ্রাম বা সংগঠনের মনোভাব তৈরি হয় না। সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোক্রেডিট একটি আনপ্রোডাক্টিভ বিজনেস, এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি “depoliticization” ঘটায়—অর্থাৎ, মানুষ আর বড় কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা ভাবে না। তারা ব্যস্ত থাকে কিস্তি শোধে। এভাবে মাইক্রোক্রেডিট একপ্রকার neoliberal containment strategy হয়ে ওঠে—যার মাধ্যমে দারিদ্র্যকে নির্মূল না করে “ম্যানেজ” করা হয়। বিশেষ করে ড. ইউনুস ও তার গ্রামীণ মডেল এই ব্যবস্থার বিশ্বমুখপাত্র হয়ে ওঠে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটি সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর এক “সিস্টেমিক টুল” হিসেবেই কাজ করেছে।

কেন জামাত-শিবির ও হেফাজতের সাথে প্রফেসর ইউনূসের গভীর কেমেস্ট্রি? এটা বুঝতে এখন আর কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয় বলেই আমি মনে করি। মাইক্রোক্রেডিটের একমাত্র শত্রু ছিল মুসলিমরা কারণ তারা ভেবেছিল এটি একটি সুদের বিজনেস আর তারা এটাকে সবসময় ডেমোনাইজ করেছিল। প্রফেসর ইউনূস যদি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের আনুগত্য স্বীকার না করে, তাহলে এটি সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে যায়, আর সাম্রাজ্যবাদ কখনোই চায় না ইউনূস ধর্মবিরোধীতা, সমকামিতা ও বিবর্তবাদ প্রমোট করুক। তারা চায় ইউনূস প্রয়োজনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুক, তারপরও দেশের সর্বস্তরের মানুষ শেখ হাসিনার বিপক্ষে ইউনাইটেড থাকুক, ইন্ডিয়ার আধিপত্যের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াক। সাম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের মাইক্রোক্রেডিট ও মুসলিম দুজনকেই লাগবে। আপনি হয়তো লক্ষ্য করলে দেখবেন, পিনাকী মুসলিম হতে রাজি, তারপরও সে শেখ হাসিনা অথবা ইন্ডিয়াকে সমর্থন করতে রাজি নয়। আপনার কি মনে হয় না এরা আমেরিকার এক একটি এজেন্ট? কেন এদের সবার কাছে ইসলাম ধর্ম এতটা লোভনীয় ও আকর্ষণীয়? কারণ তারা জানে মুসলিমরা উন্মাদ ও বিকৃত, এদের দিয়ে যাচ্ছে তাই করিয়ে নেয়া যায়, আর এজন্য আপনার যা প্রয়োজন তা হলো কনফার্মেশন বায়াস তৈরি করা। জনগণ যা বলতে চায়, আপনাকে তাই বলতে হবে, তারা যা শুনতে চায় আপনাকে তাই শোনাতে হবে।

এ পদ্ধতিতে আপনি বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিমকে খুব অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, মুসলিমরা এমন এক জাতি তারা এমিগডালা দ্বারা পরিচালিত, তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স আন্ডার‍্যাক্টিভ। একদল ভেড়ার পালের মানবাধিকার ও বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার নামই হয়তো গণতন্ত্র।

Tags :

Leehon Prime

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025