বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রতার ভয়ংকর চিত্র আবারও প্রকাশিত হলো রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে। ২০২৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, নিজেকে ‘ইমাম মাহদী’ দাবি করা নুরুল হক ওরফে ‘নূরাল পাগলা’র কবর খুঁড়ে তার মরদেহ টেনে বের করে জনতা প্রকাশ্যে আগুনে পোড়ায়। শুধু তাই নয়, তার দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। আহত হন পুলিশ, প্রশাসন ও ভক্ত-অনুসারীসহ পঞ্চাশজনেরও বেশি মানুষ। এই ভয়াবহ ঘটনা প্রমাণ করল, মাহদীর ধারণা আজও কেবল বিশ্বাসের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সমাজে বিভাজন ও সহিংসতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘মাহদী’ শব্দের অর্থ— “যিনি আল্লাহর দিকনির্দেশনায় সঠিক পথে পরিচালিত।” ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, কিয়ামতের পূর্বে মাহদী আবির্ভূত হয়ে অন্যায়-অবিচার দূর করবেন, পৃথিবীতে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন।
সুন্নি মুসলমানদের বিশ্বাস: মাহদী এখনও জন্ম নেননি; ভবিষ্যতে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর হিসেবে আবির্ভূত হবেন।
শিয়া বিশ্বাস : দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদী (জন্ম ৮৬৯ খ্রি.) গায়ব আছেন এবং একদিন ফিরে আসবেন।
এই দুই ধারার ব্যাখ্যায় পার্থক্য থাকলেও মূল বিশ্বাস এক— মাহদী হবেন ন্যায়পরায়ণ নেতা, যিনি মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবেন।
ধারণাটি এত গভীরভাবে মুসলিম চেতনায় প্রোথিত যে ইতিহাসে বারবার মানুষ নিজেকে মাহদী দাবি করেছেন। আব্বাসীয় আমলে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকার মুহাম্মদ বিন তুমার্তের “আলমোহাদ আন্দোলন”—সব ক্ষেত্রেই মাহদীর নামে রাজনৈতিক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে।
উনবিংশ শতকের সুদানে মুহাম্মদ আহমদ নিজেকে মাহদী ঘোষণা করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ভারতেও একই ধারা দেখা যায়। সাইয়্যিদ আহমদ বেরেলভী শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদে নেতৃত্ব দেন এবং ১৮৩১ সালে বালাকোট যুদ্ধে শহীদ হন। আবার মীরজা গুলাম আহমদ শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ইসলামের পুনর্জাগরণের ঘোষণা দেন, নিজেকে মাহদী ও মসীহ হিসেবে পরিচিত করেন। তার অনুসারীরা আজও আহমদিয়া বা কাদিয়ানী নামে বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান, যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় তারা নির্যাতনের শিকার। এমনকি ১৯৭৯ সালে সৌদি আরবের কাবা শরিফেও মাহদী দাবির অজুহাতে ভয়াবহ অবরোধ সংঘটিত হয়, যার রক্তাক্ত পরিণতি আজও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাহদী প্রসঙ্গ ঘিরে ভয়াবহ সংঘাত ঘটে। ১৯৫৩ সালে লাহোরে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গার কেন্দ্রে ছিল আহমদিয়া সম্প্রদায়। আহমদিয়া নেতা চৌধুরী জাফরুল্লাহ খান মন্ত্রীত্ব পাওয়ায় উগ্র ইসলামপন্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদীর গ্রন্থ “কাদিয়ানী সমস্যা” দাঙ্গার আগুনে ঘি ঢালে। তিনি আহমদিয়াদের মুসলিম পরিচয় বাতিলের দাবি তুলেন।
মার্চ মাসে লাহোর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। আহমদিয়াদের ঘরবাড়ি, মসজিদ ও দোকানপাট ধ্বংস হয়। সরকারের বাধ্য হয়ে মার্শাল ল’ জারি করতে হয়। মওদূদী গ্রেফতার হন, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন; পরে তা যাবজ্জীবন এবং অবশেষে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান।
এই দাঙ্গা পাকিস্তানের রাজনীতিতে গভীর ছাপ ফেলে— একদিকে ধর্মীয় দলগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে আহমদিয়ারা প্রান্তিক হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশে বড় আকারের মাহদী আন্দোলন কখনো হয়নি। তবে স্থানীয়ভাবে কোনো কোনো সাধককে মাহদী বলে মানার প্রবণতা ছিল। নূরাল পাগলাকে ঘিরে সাম্প্রতিক দাঙ্গা তারই ভয়াবহ রূপ। মরদেহ উত্তোলন ও পুড়িয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে সমাজে অমানবিকতা ও ধর্মীয় উগ্রতার যে চিত্র ফুটে উঠল, তা কেবল একজন ব্যক্তির ভাগ্য নয়, পুরো সমাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ইমাম মাহদীর ধারণা মূলত ন্যায় ও শান্তির প্রতীক হয়ে থাকলেও ইতিহাসে তা বহুবার রাজনৈতিক উচ্চাশা, বিদ্রোহ ও সহিংসতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাকিস্তানের লাহোর দাঙ্গা হোক বা বাংলাদেশের গোয়ালন্দের সাম্প্রতিক সহিংসতা—সবই প্রমাণ করে মাহদী প্রসঙ্গ কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিধিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক বিভেদ ও অনিশ্চয়তার আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে।
ধর্মের নামে যে অমানবিকতা সংঘটিত হয়েছে—কবর খুঁড়ে মৃতদেহ পোড়ানো—তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যখন ধর্ম অন্ধ উগ্রতায় পরিণত হয়, তখন তা মানবিকতার মূল শেকড়কেই ছিন্নভিন্ন করে দেয়।