উনার নাম হুমায়ূন আহমেদ, যিনি আমাকে ভাবতে শিখিয়েছেন

আমার এই ক্লাসটাতে অতো ছাত্র নেই, বেশির ভাগ ছাত্রী। জেন-জি ছাত্রীদের মন বোঝা বড় মুশকিল। একটা কিছু বললেই, খিলখিল করে হেসে উঠে। বুদ্ধিমান লোকের সাথে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়, গাধা টাইপ লোকের সাথেও কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। যাদের বুদ্ধি মাঝামাঝি, এদের সাথে কথা বলে আনন্দ নেই। আমার ধারনা আমেরিকা এসে আমি আরো গাধা হয়েছি, তাই হয়তো আমার কথায় স্টুডেন্টরা আনন্দ পায়। হাসলে মেয়েদের যত সুন্দর লাগে হাসি চেপে রাখলে তারচে দশ গুন বেশি সুন্দর লাগে। আমার ক্লাছে এক ছাত্র আছে সে একেবারেই হাসে না। মুখ গম্ভীর করে পেছনে বসে থাকে। ক্লাসে তার মন নেই। একদিন সে আমাকে প্রশ্ন করে, “মিস্টার ফয়সাল, আপনার প্রিয় লেখক কে?”

অনেক প্রিয় একটা বা একজন হয়না। যেমন প্রিয় খাবার, প্রিয় মুভি, প্রিয় মানুষ এগুলো বিষয়ে আমি কখনো এক বাক্যে উত্তর দিতে পারিনা। কিন্তু প্রিয় লেখকের প্রসঙ্গ উঠতে, আমিও তার মতো বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে উত্তর দিলাম, ”উনার নাম হুমায়ূন আহমেদ। তিনি আমাকে ভাবতে শিখিয়েছেন।”

সত্যি বলতে আমি লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে নির্মাতা হুমায়ূনের বেশি ভক্ত। আসলে কমপেয়ার করাও ঠিক হবে না হয়তো। এভাবে বলা যায়, লেখক যখন নির্মাতা হয়ে উঠেন, সেই নির্মাণ অন্য লেভেলে চলে যায়।

হুমায়ূন আহমেদের ছিল নানামাত্রিক খেয়ালিপনা। শুটিংয়ের ফাঁকে তাঁর সেসব খেয়ালিপনা নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন অভিনেতারা। কেউ কেউ সেসব উপভোগও করতেন। হুমায়ূনের বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। তাঁর লেখা নাটকে অভিনয় করে খ্যাতিও পেয়েছেন এই তারকা। হুমায়ূন আহমেদের খেয়ালিপনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, যখন নাটক লিখতেন, তখন তিনি অভিনেতাকে সেটা পড়ে শোনাতেন। কখনো কখনো অভিনয়শিল্পীদের কাছে মতামত চাইতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মত দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। তিনি এমনভাবে সবকিছু তুলে ধরতেন, সেখানে অন্যদের তেমন কিছু বলার থাকত না।

মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূনের নাটক–সিনেমার অভিনেত্রী। পরে তিনি হন হুমায়ূনের স্ত্রী। শুটিংয়ের বাইরে হুমায়ূনকে সবচেয়ে বেশি দেখেছেন এই অভিনেত্রী। শুটিং অবকাশের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘শুটিংয়ে একদিন দেরি মানেই খরচ বেড়ে যাওয়া। শিল্পীদের শিডিউলও পাওয়া যায় না। সেখানে হুমায়ূন আহমেদই মনে হয় একমাত্র পরিচালক, যিনি বাংলাদেশের খেলা থাকলে শুটিং বন্ধ করে দিতেন। সবাইকে নিয়ে খেলা দেখতে বসে যেতেন। বৃষ্টি হলেই তিনি শুটিং বন্ধ করে সবাইকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেন।’

পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে। কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে। ফিল্ম মেকিং নিয়ে আমার আগ্রহ বিশ্বের কোন বড় বড় নির্মাতার ইন্সপায়রেশনে হয়নি। বাংলাদেশী লেখক হুমায়ূন আহমেদ, আমার মনের এই জানালাটি খুলতে পেরেছিলেন। পত্রিকায় বইয়ে যখন তার পাগলামির গল্পগুলো পড়তাম। আমিও হুমায়ূনের মতো পাগল হতে চাইতাম। উনি বোধহয় একমাত্র সেলিব্রেটি যার মৃত্যুর পর আমি নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। হাওমাও করে কেঁদেছি।

হুমায়ূনের মৃত্যুদিনকে সামনে রেখে, উনাকে নিয়ে বিভিন্ন মানুষের স্মৃতি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলাম কোন এক বর্ষায়। সেই থেকে সিলেট শহরে জন্ম নেয় আমার প্রাণের সংগঠন কাকতাড়ুয়া। আজ হুমায়ূনের জন্মদিনে, আমেরিকার টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি স্টুডেন্টদের ”সিনেমাটিক কম্পোজিশন” শেখাচ্ছি। ক্লাসরুমকে ফিল্ম স্টুডিও বানিয়েছি। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যামেরা ধরছে, অভিনয় করছে, এডিটিং করছে। আমার লেকচারের পর তালি দিচ্ছে। আমার মতো ভিনদেশীর কাছ থেকে ওরা কতটুকু শিখলো জানিনা। তবে আমি দারুন এনজয় করছি। পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দময় জিনিসগুলির জন্যে কিন্তু টাকা লাগে না। বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন ধরুন জোছনা, বর্ষার দিনের বৃষ্টি, মানুষের ভালবাসা।

টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্রাজুয়েট ক্লাসরুমে “সিনেমাটিক কম্পোজিশন” শেখাচ্ছেন লেখক

ক’দিন পর থ্যাংক্স গিভিং। আমার এক স্টুডেন্ট বললো, “আমি যখনি আপনার অফিসের সামনে যাই, দেখি চুপচাপ কাজে বুদ হয়ে আছেন। আপনার বন্ধু বান্ধব নাই? উইকেন্ডে পার্টি শার্টি করেন না?” সঙ্গপ্রিয় মানুষের জন্য নিঃসঙ্গতার শাস্তি কঠিন শাস্তি। এই শাস্তি মানুষকে বদলে দেয়। আমাকেও বদলে দিয়েছে। এটা সত্য আমার এখানে কাজে ডুবে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। লাজুক হেসে উত্তর দিলাম, “কেন এই প্রশ্ন করলে, বলো তো?” সে বলে, “সামনের থ্যাংক্স গিভিং ডে তে আপনি আমাদের বাসায় আসুন। আমি আমার মা কে বলেছি। অন্য দেশ থেকে একলোক এসেছে আমাদের ডিপার্টমেন্টে, দেখে মনে হয় তার কোন বন্ধু-বান্ধবী নেই। মা-ই আপনাকে ইনভাইট করতে বললেন।” কী উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। টিচিং এসিসট্যান্ট ট্রেইনিং এর সময় স্পষ্ট করে বলে দেয়া আছে, কোন স্টুডেন্ট এর সাথে প্রেম, বন্ধুত্ব বা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়া যাবেনা। আমি হ্যাঁ না কিছুই বলিনি, রহস্য রেখে দিয়েছি। তবে আমার একেবারে বন্ধু নেই এটা ঠিক না। এখানে এসে দারুন কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি।

হুমায়ূনের মতো করেই বলতে হয়, “একেকজন মানুষ যেন একেকটা বই। কোনো বই সহজ, তরতর করে পড়া যায়। কোনো বই অসম্ভব জটিল। আবার কোনো কোনো বই এর হরফ অজানা। সেই বই পড়তে হলে আগে হরফ বুঝতে হবে। আবার কিছু কিছু বই আছে যার পাতাগুলি শাদা। কিচ্ছু সেখানে লেখা নেই, বড়ই রহস্যময় সে বই। আমার নিজের বইটা কেমন? খুব জটিল নয় বলেই আমার ধারণা। সরল ভাষায় বইটি লেখা। যে কেউ পড়েই বুঝতে পারবে। কিন্তু সত্যি কি পারবে? সারল্যের ভেতরেও তো থাকে ভয়াবহ জটিলতা।“

Tags :

Faysal Khalilur Rahman

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025