আফগানিস্তান সফরে গেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হকসহ সাতজন। বুধবার সকালে দেশটির রাজধানী কাবুলে গিয়ে পৌঁছান তারা।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই সফরের তথ্য জানিয়েছে খেলাফত মজলিস। এতে তারা বলেছে, ‘ইমারাতে ইসলামিয়া’ বা তালেবান সরকারের আমন্ত্রণে সফরকারী দলটি আফগানিস্তানে গেছে। কাবুলে তারা তালেবান সরকারের প্রধান বিচারপতি, একাধিক মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করার কথা রয়েছে। বিশেষভাবে মানবাধিকার ও নারী অধিকার বিষয়ে পশ্চিমা মহলে যে সমালোচনা রয়েছে, সে প্রসঙ্গেও তারা বাস্তব অবস্থান সরাসরি পরিদর্শন করবেন।
তবে পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা বিষয়টি নিয়ে মামুনুল হক কেন পরিদর্শন করছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, সেখানে আসলে নারী অধিকার লুণ্ঠন বা হরণ হচ্ছে কি না এটা বাস্তবে দেখবেন তারা। অনেক সময় হয় না যে, একটা বিষয়ে বিভ্রাট ধারণা থাকে, একটা শ্রেণির লোক তো এই বিষয়টা প্রচার করে যে নারীর অধিকার নারীকে ঘরে আটকে রাখে। তারা জানবেন আসলে বিষয়টি সত্য কি না।
এদিকে, খেলাফত মজলিসের আমির ও তার প্রতিনিধি দল এমন এক সময়ে এই সফর করছেন, যখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ পাঁচ দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ শুক্রবার সব বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল হওয়ার কথা রয়েছে।
রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা আফগানিস্তানে গিয়েছেন এমন কোনো নজির নেই। এই প্রথম কোনো দলের নেতাদের আফগানিস্তান সফরের কথা শুনছেন তারা।
দলটির মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ জানান, এই সফরটি দলীয় কোনো সফর নয় বরং ওলামা সমাজের সফর। একইসাথে সফরে দলের আমির মামুনুল হক থাকলেও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নয় এমন অনেকেই আছেন বলে জানান তিনি।
জালালুদ্দীন আহমদ জানান, এর আগে ২০০১ সালেও ‘ওলামা সমাজ’ আফগানিস্তান সফর করেছেন।
রাশিয়া ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে স্বীকৃতি না দিলেও অর্থনৈতিক লেনদেন করছে বেশ কয়েকটি দেশ।
এমনকি বাংলাদেশের কোনো দূতাবাসও নেই আফগানিস্তানে। তবে বাংলাদেশে আফগানিস্তানের দূতাবাস আছে। উজবেকিস্তানের বাংলাদেশ দূতাবাস সমদূরবর্তী মিশন হিসেবে আফগানিস্তানে কাজ করে থাকে।
আফগানিস্তানে ২০২১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর ক্ষমতাসীন তালেবান সেদেশের নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিষিদ্ধ করে এবং প্রাইভেট টিউশন কেন্দ্রগুলোর প্রতি আদেশ দেয় যেন তারা কোন ছাত্রীকে শিক্ষাদান না করে। এসব প্রেক্ষাপটে দেশটির তালেবান সরকারের সাথে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের কী বা কেমন সম্পর্ক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে?
দলটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুধবার জানিয়েছিল, সফরের সময় দুই দেশের আলেমদের মধ্যকার সম্পর্কান্নয়নসহ কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোকে প্রতিনিধি দল আলোচনায় অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
এই সফরে মামুনুল হকসহ সাত সদস্যের দলটি মধ্য এশিয়ার আরেও কয়েকটি দেশে যাবেন বলে জানানো হয়েছে। দলটি জানিয়েছে, গত ১৪ই সেপ্টেম্বর দলের আমির মামুনুল হকসহ প্রতিনিধিদল পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান। সেখানে তারা ওমরাহ আদায় শেষে বুধবার সকালে দুবাই হয়ে কাবুলে পৌঁছান।
দলটির মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আলেম সমাজের পক্ষ থেকে আলোচনা ও সম্পর্কোন্নয়নের জন্য এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সফরটা কোনো দলীয় উদ্যোগে নয়, যারা গেছেন অনেকে রাজনীতি করেন না এমন লোকও আছেন। বাংলাদেশের আলেম সমাজের পক্ষ থেকে একটা প্রতিনিধি দল সম্পর্কোন্নয়নের জন্য গিয়েছেন।
মামুনুল হক ছাড়াও সফররত বাকিরা হলেন- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ (মধুপুরের পীর) ও দলটির আরেক নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল আউয়াল। এ ছাড়াও ময়মনসিংহ বড় মসজিদের খতীব মাওলানা আব্দুল হক, বারিধারা মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী, জমিয়ত নেতা মাওলানা মনির হোসাইন কাসেমী ও ময়মনসিংহের স্থানীয় আলেম মাওলানা মাহবুবুর রহমান এই সফরে আছেন।
খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় মামুনুল হলের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করলে জালালুদ্দীন আহমদ জানান, এই সফরের প্রক্রিয়া আগে থেকেই ছিল, কর্মসূচি পরে হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, এর আগে ২০০১ সালেও বাংলাদেশের ওলামা সমাজ (ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব) আফগানিস্তান সফর করেছিলেন। তবে তাদের কেউই এখন বেঁচে নেই। সে সময় মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবান সরকার কাবুলের ক্ষমতা দখল করেছিল। ২৫ বছর আগের ওই সফরে মামুনুল হক ছিলেন না।
খেলাফত মজলিস বাংলাদেশের মহাসচিবের দাবি, তালেবান সরকারকে অনেক দেশ স্বীকৃতি না দিলেও সমর্থন রয়েছে। সে কারণেই দুটি মুসলিম দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যই ওলামা সমাজের এই সফর।
সেক্ষেত্রে দলের পক্ষ থেকে কেনে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়েছে এমন প্রশ্নে জালালুদ্দীন আহমদের দাবি, মামুনুল হকের দুটি পরিচয় রয়েছে। একদিকে তিনি আলেম, ইসলামিক স্কলার আরেকদিকে উনি দলের প্রধান। এই হিসেবেই আমাদের অফিস থেকে উনার এই মেসেজটা সবাইকে জানানো হয়েছে।
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকা তালেবানদের সাথে খেলাফতে মজলিস বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না এমন প্রশ্নে সে সম্ভাবনা নাকচ করে দেন দলটির মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কারো সাথে কোনোদিন দেখাও হয় নাই, যোগাযোগও হয় নাই, কথাও হয় নাই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করছেন, এই ধর্মভিত্তিক দলটি হয়তো ইসলামি শাসনের মডেল নিয়ে ধারণা পেতে আফগানিস্তান সফর করছে। বাংলাদেশে এই মডেল কিভাবে কাজে লাগানো যায় এবং সে বিষয়ে পথ খুঁজতে চাচ্ছে দলটি।
তিনি বলেন, ফরমালি যেটা বিভিন্ন সোর্স থেকে শুনি বা জানি যে, আফগানিস্তানের ইসলামি শাসনের মডেল নিয়ে বাংলাদেশের একটা শ্রেণির মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সম্ভবত তারা ওই সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়ার জন্য হয়তো আফগানিস্তানে গেছে। আমি নিজেও হয়তো বলতে পারবো না এই মডেলটা কেমন ধরনের। এই মডেল অনেক বেশি রিজিড, শরিয়াপন্থী অর্থাৎ অতটা লিবারেল না।
এ ধরনের মডেল বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে পারবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে খেলাফত মজলিসের নেতারা সফর শেষে দেশে ফিরে সফর সম্পর্কে কী জানায় সে অপেক্ষা করার কথা বলেছেন এই বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, তারা হয়তো একটা ওয়ে আউট দেখতে চাচ্ছে যে ইসলামী শাসনের মডেলটা কী? সেই মডেলটা হয়তো তারা বাংলাদেশে কাজে লাগাতে চাইতে পারে আমি যতদূর বুঝি।
তবে এমন বিষয় নাকচ করে দিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ। তিনি উল্লেখ করেন, যদি কোনো দেশে কোরআন এবং সুন্নাহ বা শরীয়াহ রাষ্ট্র কায়েম হয়, তখন সেখানে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের প্রশ্ন আসে। আমাদের দেশে তো এই আইন বাস্তবায়ন করার প্রশ্ন নাই, যেহেতু ইসলামিক সরকার নাই। আফগানিস্তানের শাসন, সরকার ব্যবস্থা একরকম, বাংলাদেশের শাসন ও সরকার ব্যবস্থা ভিন্ন রকম। অতএব কেউ চাইলেও সেটা প্রয়োগ করতে পারবে না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা