দীর্ঘ দশকের সংঘাত, যেটি কখনোই পুরোপুরি নীরব ছিল না, এবার যেন আগুনে ঘি পড়েছে। ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনার ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, গোটা বিশ্বের ভূরাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পাল্টা জবাবে ইরানও আঘাত হেনেছে, এবং এর ফলে একদিকে বেসামরিক প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে ঘনীভূত হচ্ছে আশঙ্কা—এই লড়াই কি শুধুই কৌশলগত, না কি এটিই সেই যুদ্ধ যা আরেকটি বিশ্বসংঘর্ষের মুখোমুখি আনবে?
ইসরায়েলের কৌশলগত ভাবনা ছিল ইরানের দুর্বলতা ব্যবহার করে একটি নির্ধারিত সময়ে নির্ভুল হামলা চালানো। হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য প্রক্সি যোদ্ধাদের দুর্বল অবস্থা এবং ইরানের ভঙ্গুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল বিমানবাহিনী সরাসরি ইরানের স্থলভাগে ঢুকে আঘাত হানে। তাতে ইঙ্গিত ছিল—আমরা প্রস্তুত, আমরাই নেতৃত্ব দেব।
তবে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সম্পূর্ণ ধ্বংস নয়, বরং সেটিকে বিলম্বিত করা। আর সেই বিলম্বই হতে পারে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের প্রস্তুতির সময়সীমা। এদিকে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে আরও দ্রুত এগোয়, তবে এই হামলা উল্টো তাকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করতে পারে।
ইসরায়েলের ছুড়ে দেওয়া শত শত নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্রের উত্তরে ইরান যখন আকাশজুড়ে তার প্রতিশোধের সিম্ফনি বাজালো, তখন অনেকেই ভেবেছিল, এ তো কেবল ‘প্রতীকী আঘাত’। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। তেহরান প্রতিবার ইঙ্গিত দিয়ে বলছে—প্রতিশোধ এখনো শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছে যুদ্ধের নতুন অধ্যায়।
ইরান যুদ্ধকে শুধুমাত্র মাটির উপরের ট্যাঙ্ক ও বিমানের সীমায় দেখছে না। এই প্রতিক্রিয়া ছিল প্রথম স্তর—পাবলিক, দৃশ্যমান এবং হিসেবি। আসল ঘুঁটিগুলো এখনো চালা হয়নি। ইরান জানে—ইসরায়েলের হৃৎপিণ্ড কোথায়, তার অর্থনীতি কোথায় নরম, আর এর গোয়েন্দা প্রতিরক্ষায় কোথায় ফাটল। তাই, সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি সাইবার আঘাত, জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন, কিংবা গোপন অপারেশনের মাধ্যমে ইরান ধীরে ধীরে ইসরায়েলের নিরাপত্তাবোধকে ধ্বংস করে দিতে চায়।
ইসরায়েল যেখানে প্রতিটি হামলায় বিশ্বমঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ইরান সেখানে সময় নিয়ে, হিসেব করে, এবং আঘাত করে তখন, যখন প্রতিপক্ষ সেটি একেবারে কল্পনাও করে না। এই প্রতিক্রিয়া ছিল এমন এক কৌশলগত বার্তা: তোমার আকাশ হয়তো নিরাপদ, কিন্তু “তুমি” নিরাপদ না।
প্রক্সি শক্তি হয়তো ক্ষয়প্রাপ্ত, কিন্তু ইরান এখনো তার ‘অভ্যন্তরীণ চক্র’—যেমন হিজবোল্লাহ, হাউথি, শিয়া মিলিশিয়া—যেখানে প্রয়োজন সেখানে সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম। বাস্তবতা হলো, ইরান আর ‘প্রতিশোধের দেশ’ নয়, বরং এক ‘ধৈর্যশীল প্রতিদ্বন্দ্বী’, যার প্রতিটি পদক্ষেপ হঠাৎ নয়, বরং ধারাবাহিক ও কৌশলী।
এই সংঘাতে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ আরও প্রকট, কারণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনা বহন করে। যদিও আইএইএ নিশ্চিত করেছে যে উচ্চমাত্রার বিকিরণ ছড়ায়নি, তবুও এটি আন্তর্জাতিক আইনের চোখে একটি বিপজ্জনক নজির। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা জাতিসংঘ সনদের সরাসরি লঙ্ঘন।
এই সংঘাত ওয়াশিংটন ও জেরুজালেমের মধ্যে নতুন ধরণের মতানৈক্যও প্রকাশ করছে। ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধ এড়াতে চায়, কিন্তু নেতানিয়াহু এটি সময়োপযোগী বলে মনে করেন। এই দ্বন্দ্ব মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে, পারমাণবিক আলোচনার সম্ভাবনা প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। ইরান এখন হয়তো পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে এগোবে, নয়তো ওয়াশিংটনের আহ্বানে সাময়িক আপস করে ইসরায়েলকে থামানোর চেষ্টা করবে।
ওয়াশিংটন ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে—ট্যাঙ্কার বিমান, যুদ্ধজাহাজ, বিমানবাহী রণতরী—সবই মোতায়েন। এটা একদিকে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষায় সহায়তা, অন্যদিকে নিজের প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রস্তুতি।
অন্যদিকে ইরানের প্রক্সিগুলোর ভেতরে ছত্রভঙ্গ দশা। হামাস বিপর্যস্ত, হিজবুল্লাহ অস্থির, হাউথি ও শিয়া মিলিশিয়ারা ক্ষীণ প্রতিক্রিয়ার বাইরে কিছু করতে পারছে না। এই যুদ্ধ গাজার ওপরও চাপ বাড়াবে, কারণ আন্তর্জাতিক মনোযোগ বিভক্ত হচ্ছে, আর ইসরায়েল গাজায় তার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। হামাসের জন্য এই যুদ্ধ কৌশলগতভাবে লাভজনক নয়।
রাশিয়া পরিস্থিতি থেকে লাভ তুলতে পারে—তেলের দাম বাড়বে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি পশ্চিমা মনোযোগ কমবে। তবে ইরানে যদি শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, মস্কোও তার প্রভাব হারাবে। চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে চায়, তবে তার শক্তি এখনো সীমিত।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কা—এই সংঘাত বিস্তারের ঝুঁকি বহন করছে। আইএইএ এর মধ্যেই ইরানকে এনপিটি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, এবং সেই পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
তেল ও গ্যাস স্থাপনাগুলোতে হামলার ফলে ইরানের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপর্যস্ত, জনগণের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। হর্মুজ প্রণালীতে উত্তেজনা বাড়লে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহও হুমকির মুখে পড়বে।
দেশের ভেতরে ইরান সরকার এখনও একতাবদ্ধ, কিন্তু জনগণের অসন্তোষ বাড়ছে। বেসামরিক প্রাণহানি ও অব্যবস্থাপনার কারণে অসন্তোষ আরও বাড়তে পারে। ইসরায়েলি জনমত এই মুহূর্তে যুদ্ধকে সমর্থন করছে, তবে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই জনসমর্থনকে কতটা ধরে রাখতে পারবে, তা সময় বলবে।
সবশেষে, যুদ্ধবিরতি সম্ভব হলেও তা ঠুনকো। ইসরায়েল তার অভিযান থামাবে না যতক্ষণ না নিশ্চিত হয় যে ইরান আবার পারমাণবিক কর্মসূচি গড়ে তুলতে পারবে না। ইরানও নিজেদের জনগণের সামনে হেরে যেতে চায় না। ট্রাম্প এখানে তৃতীয় পক্ষ হয়ে উঠতে পারেন—চলমান যুদ্ধকে কৌশলগত থামানোর একমাত্র রাজনৈতিক সুযোগ তার হাতেই।
এই যুদ্ধ যদি শেষও হয়, তা হতে পারে আরও ভয়াবহ যুদ্ধের প্রস্তুতি— ভবিষ্যতের সেই লড়াই, যেটির আগুনে পুড়বে গোটা অঞ্চল।