গোপন মার্কিন দলিল প্রকাশ, ১৯৭১ শুধু যুদ্ধের ইতিহাস নয়, নীতিরও রক্তমাখা গল্প

সম্প্রতি প্রকাশিত এক গোপন মার্কিন দলিল পড়ে মনে হলো, ইতিহাস শুধু যুদ্ধের নয়, নীতিরও রক্তমাখা গল্প। এই নথির সারসংক্ষেপ পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করে নেওয়াটা জরুরি মনে করছি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিকৃত করে নতুন গল্প লিখতে চাইছেন, তাদের এই সাজানো বয়ানের বিপরীতে সিআইএ-প্রকাশিত নথিটি এক অপ্রতিরোধ্য দলিল।

এটি স্পষ্ট করে দেয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান এখানে কোনো পিকনিকে আসেনি, বরং পরিকল্পিত গণহত্যার রাজনীতি চালিয়ে গেছে পরাশক্তির নীরব সমর্থনে। নব্য বুদ্ধিজীবীদের বিকৃত ইতিহাস পড়ার আগে, একবার oreign Relations of the United States এর ওয়েবসাইট ঘুরে আসুন। এই একটি ওয়েবসাইটই এইসব বিকৃত মানসিকতার বুদ্ধিজীবীদের মুখে ঝাটা মারার জন্য যথেষ্ট।

নথি নং-১৪৪ এর সারসংক্ষেপ আপনাদের জন্য অনুবাদ করছিঃ

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুমে অনুষ্ঠিত উচ্চ-পর্যায়ের এক গোপন বৈঠকের বিবরণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক গোপন নথি পাবলিক করেছে CIA। এটি পড়লে বুঝা যায়, তা শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি নথি নয়; এটি সেই সময়ে নিক্সন প্রশাসনের শীতল, কঠোর এবং একপেশে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল কি পরিমাণ নগ্ন ছিল। এই নথিতে দেখা যায়, ওয়াশিংটনের মূল মনোযোগ ছিল মানবিক সংকটের সমাধান নয়, বরং তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করার জন্য চীন-মার্কিন সম্পর্ককে সুরক্ষিত রাখা।

পাকিস্তানকে ‘বাঁচানো’ই ছিল আমেরিকার মূল লক্ষ্য!

প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুমে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে কথা হলেও, এর গভীর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখা।

পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব: নথি অনুযায়ী, মার্কিন কর্মকর্তারা খোলাখুলিভাবে বলছেন যে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ত্রাণ প্রচেষ্টার অগ্রাধিকার দিতে রাজি হয়েছেন, কারণ এটি ‘পূর্ব পাকিস্তানে একটি সরকারী অবস্থান বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ’। অর্থাৎ, ত্রাণকে দেখা হচ্ছিল সামরিক শাসনের একটি সহায়ক সরঞ্জাম হিসেবে।

অর্থনৈতিক প্যাকেজ: ঋণ পুনঃতফসিল (Debt Rescheduling)-এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে $৭৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সুবিধা দেওয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে, সামরিক সরবরাহ বন্ধ করা নিয়েও আলোচনা হয়েছে, তবে তা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে নয়, বরং মার্কিন কংগ্রেসের সমালোচনার মুখ বন্ধ করার জন্য (গ্যালাঘার অ্যামেন্ডমেন্ট)। অর্থাৎ, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখতে মার্কিন প্রশাসন সচেষ্ট ছিল।

মুজিবকে নিয়ে কৌশল: শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন কিনা তা নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও, তারা স্বীকার করেন যে মুজিবুর রহমান ‘মৃতের চেয়ে জীবিত বেশি মূল্যবান’, রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে এবং আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর জন্য।

ভারতের প্রতি সন্দেহ ও কঠোরতা: নথির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ভারতকে দেখা হয়েছে প্রতিপক্ষ হিসেবে, মিত্র হিসেবে নয়।

শরণার্থী গণনা নিয়ে অনাস্থা: ভারত যেখানে ৮ মিলিয়ন শরণার্থীর কথা বলছে, সেখানে মার্কিন কর্মকর্তারা শরণার্থী সংখ্যা নিয়ে একটি ‘নিরপেক্ষ গণনা’ করার জন্য চাপ দিতে চেয়েছেন। কিসিঞ্জার ভারতীয়দের খেলাকে ‘একেবারে নির্মম খেলা’ (absolutely ruthless game) বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে, ভারত এই শরণার্থীর স্রোতকে ‘যুদ্ধ শুরু করার অজুহাত’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। প্রকৃত পক্ষে ভারতে আনঅফিসিয়ালি প্রায় দুই কোটি বাংলাদেশী শরনার্থী ছিল।

সামরিক সতর্কবাণী: ভারত যেন সামরিক কার্যকলাপে না জড়ায়, সে ব্যাপারে পুনরায় সতর্কবাণী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

চীন ফ্যাক্টর: সবচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত ছিল ভারতকে চীন আক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সমর্থনের আশ্বাস না দেওয়া। এই বিষয়ে কিসিঞ্জারের মন্তব্যটি স্পষ্ট, “আমাদের উচিত হবে না তাদের উদ্বেগ কমানো… এটি আমাদের গেম প্ল্যানের অংশ হওয়া উচিত, ভারতীয়দের ভাবিয়ে তোলা যে চীন কী করতে পারে।” অর্থাৎ, চীনকে ব্যবহার করে ভারতকে যুদ্ধের পথে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার একটি শীতল ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নেওয়া হয়েছিল।

মানবিক সংকটের আড়ালে দ্বৈত মানদণ্ড: আলোচনায় মানবিক ত্রাণ এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি এড়ানোর বিষয়ে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এর পাশাপাশি তথ্য গোপন ও দ্বৈত মানদণ্ডের প্রকাশ ঘটেছে।

হিন্দু সম্প্রদায়: একজন মার্কিন কর্মকর্তা (Maury Williams) উল্লেখ করেছেন যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে বার বার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। কিসিঞ্জার জানতে চেয়েছিলেন এই খবর কেন বাইরে আসেনি, তাকে তা ব্যাখ্যা করা হয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কিন প্রশাসনের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সম্পূর্ণ তথ্য ছিল, কিন্তু তারা নিজেদের কৌশলগত মিত্র পাকিস্তানকে রক্ষা করতে সেই তথ্য জনসম্মুখে আনতে ইচ্ছুক ছিল না।

ত্রাণ কর্মসূচির নিরাপত্তা: নথিতে দেখা যায়, খাদ্য ও ত্রাণবাহী জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল, কারণ গেরিলারা ত্রাণ জাহাজগুলোতে আক্রমণ করছিল। ত্রাণ বহনে জাতিসংঘ প্রতীক ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী এর সাথে অস্ত্রসজ্জিত প্রহরী রাখতে চেয়েছিল। এটি প্রমাণ করে, তৎকালীন পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রম কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং জটিল ছিল।

১৯৭১ সালের এই গোপন মার্কিন দলিলটি স্পষ্ট করে দেয় যে, যখন বাংলাদেশের মানুষ গণহত্যা ও মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন পরাশক্তি আমেরিকার প্রশাসন নৈতিকতা বা গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল তাদের কৌশলগত মিত্র পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে তাদের নতুন ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ককে। এই নথিটি দেখায়, কীভাবে বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র বন্ধুত্বের (ভারতের) দ্বারা সমর্থিত হয়নি, বরং প্রভাবশালী এক পরাশক্তির ঠান্ডা, স্বার্থপর এবং একপেশে নীতির মোকাবিলাও করেছিল।

মূল দলিলটি পুরোটা পড়তে চাইলে, নীচের লিংক থেকে পড়ে নিতে পারেন।

তথ্যসুত্রঃ
নথি নং-১৪৪. ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশনস গ্রুপ মিটিংয়ের কার্যবিবরণী
ওয়াশিংটন, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, বিকেল ৩টা ০৭ মিনিট – ৪টা ২৫ মিনিট।
(Foreign Relations of the United States, 1969–1976, Volume XI, Document 144)
https://history.state.gov/historicaldocuments/frus1969-76v11/d144?fbclid=IwY2xjawN93N1leHRuA2FlbQIxMQBzcnRjBmFwcF9pZBAyMjIwMzkxNzg4MjAwODkyAAEe7jq6PBXuJgt8I9DMlYV9nRuC2dwZQ50Xi-gPDLObi8729HXWHL5W-6VS3Zs_aem_KSAR0VeAcrSp4U4aBC8cYw

Tags :

Anamul Haque

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025