সরকারি তালিকায় থাকা ৮৩৪ জনের মধ্যে অন্তত ৫২ জন রয়েছেন, যাঁরা আসলে জুলাই শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নন। দৈনিক প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গণমাধ্যমটি টানা দুই মাস এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে।
ঢাকার ওয়ারীতে গত বছরের ১৪ আগস্ট কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিএনপি নেতা মো. আল-আমিন ভূঁইয়া ও তাঁর ছোট ভাই নুরুল আমিনকে। স্বজনেরা জানিয়েছেন, এই খুনের নেপথ্যে ছিল জমিসংক্রান্ত বিরোধ। যদিও আল-আমিনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হিসেবে প্রজ্ঞাপনভুক্ত করা হয়েছে।
ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ ও নিহতদের চারজন স্বজনের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি বিশ্লেষণ করা হয়েছে মামলার নথি। স্বজনেরা স্বীকার করেছেন, আল-আমিন ভূঁইয়া ও নুরুল আমিন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হননি।
আল-আমিনের বোন মারহুমা বলেন, হত্যার ঘটনায় তাঁরা ওয়ারী থানায় মামলা করেছেন। জড়িত আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তাহলে শহীদদের তালিকায় নাম কীভাবে উঠল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে আর কথা বলবেন না।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শহীদদের তালিকায় নাম ওঠাতে ভূমিকা রেখেছেন নিহত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা। এমন ৪১টি পরিবারের অনেকেই স্বীকার করেছেন, তাঁদের স্বজনের মৃত্যু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা সরকারি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় নাম দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্ররোচনাও দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে এককালীন মোট ৩০ লাখ টাকা দেবে সরকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরে দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রত্যেক শহীদ পরিবার মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছে। ঢাকায় তাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে প্রশ্নবিদ্ধ নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি নজরে আনা হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, সরকার তালিকাটি আবার যাচাই-বাছাই করছে। এ বিষয়ে গত ২২ জুন দেশের সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শাখার প্রধান যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, সব জেলা থেকে তথ্য এলে শহীদদের তালিকা পুনর্বিবেচনা করা হবে। আন্দোলনে যাঁদের সম্পৃক্ততা নেই, তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হবে।
২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৬ জুলাই। ওই দিন পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ মারা যান। বিভিন্ন জেলায় মারা যান আরও পাঁচজন। দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট (২০২৪) আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। তিন দিন পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার শহীদদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম গত ১৩ এপ্রিল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তাঁদের তথ্যভান্ডারে ৮৬৪ জন শহীদের হিসাব রয়েছে। শহীদদের নাম প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন সময় কিছু নাম যুক্ত হয়েছে। আবার শহীদ নন বলে শনাক্ত হওয়ায় কিছু নাম বাদ পড়েছে। ফলে এখনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি।
সর্বশেষ গত ২ আগস্ট বাদ দেওয়া হয় আটজনের নাম। এখন প্রজ্ঞাপনভুক্ত শহীদের সংখ্যা ৮৩৪। এই তালিকায় থাকা ৫২ জন সংজ্ঞা অনুযায়ী শহীদদের তালিকায় পড়েন না বলে বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে ৬১৫ নম্বর নামটি অটোরিকশাচালক জামাল উদ্দিনের (৩৫)। রাজধানীর থানা-পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে রিকশা চালানো অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন জামাল। হাসপাতালে নিলে সেদিনই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও জামালের নামটি ওঠানো হয়েছে শহীদদের তালিকায়।
পুলিশ বলছে, জামাল শহীদ নন। তাঁর বাড়ি ভোলায়। পুলিশের কাছ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হয় জামালের বোন রিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, জামাল আন্দোলনে গিয়ে আহত বা আক্রান্ত হননি। তাঁর নাম কীভাবে শহীদের তালিকায় উঠেছে, তা তিনি জানেন না। তবে তাঁরা ১০ লাখ টাকার সরকারি সহায়তা পেয়েছেন।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে ৩২৫ নম্বর নামটি খুলনার পাইকগাছার শিক্ষার্থী রকিবুল হাসানের (২৪)। স্বজনেরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। এ ঘটনায় গত ৩০ জুন পাইকগাছা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলাও হয়েছে। তবে তাঁর নাম উঠেছে শহীদদের তালিকায়।
শহীদের তালিকায় ৭৪৮ নম্বরে থাকা অটোরিকশাচালক মহিউদ্দিন মোল্লার (৪৫) স্বজনেরা কোনো মামলা করেননি। তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন বেগম দাবি করেন, মারধর ও আঘাতে ২ আগস্ট আহত হওয়ার ১২ দিন পর মহিউদ্দিন মারা যান। যদিও পুলিশ বলছে, তাঁর পরিবার কোনো মামলা করেনি। কেন মামলা হয়নি, সে খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ২ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পরে মৃত্যু হয় মহিউদ্দিনের।
বরিশালের উজিরপুরের গাড়িচালক মো. সাইফুল ইসলামের (প্রজ্ঞাপন নম্বর ৫৯১) ভাই আল-আমিন দাবি করেন, তাঁর ভাই ঢাকার রামপুরায় প্রাণঘাতী গুলিতে আহত হয়ে পরদিন মৃত্যুবরণ (২১ জুলাই, ২০২৪) করেন। অবশ্য পুলিশের একটি নথিতে দেখা যায়, গুলিতে নয়, সাইফুলের মৃত্যু হয়েছে ‘কাট ইনজুরিতে’ (কাটাছেঁড়া)। ঘটনা ঘটেছে কাকরাইল মোড়সংলগ্ন শান্তিনগর এলাকায়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পরের কয়েক দিনেও হামলা ও মারধরে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে আইন অনুযায়ী, ৫ আগস্টের (২০২৪) পরের ঘটনায় নিহতদের শহীদ তালিকায় তাঁর স্থান পাওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদদের তালিকায় পাঁচটি নাম রয়েছেন, যাঁদের মৃত্যু হয়েছে ৫ আগস্টের (২০২৪) পর। এর একটি ওয়ারীর জমিজমার দ্বন্দ্বে খুনের শিকার আল-আমিনের। বাকি চারটির দুটি নাম মো. সাইদুল ইসলাম ইয়াছিন (১৫৭ নম্বর) ও সাইফ আরাফাত শরীফের (৮২৭ নম্বর)। পুলিশের তথ্য হলো, গত বছরের ১৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর একটি হোটেলে মারামারিতে জড়িয়ে খুন হন তাঁরা।
সাইফ আরাফাতের বোন কামরুন নাহার জানান, ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিলে সেদিনই তাঁর মৃত্যু হয়।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে ১৭৯ নম্বরে থাকা ব্যবসায়ী আবু সাইদের (৩০) মৃত্যু হয়েছে গত বছরের ৯ আগস্ট। তাঁর স্বজনদের দাবি, ৪ আগস্ট (২০২৪) যাত্রাবাড়ীতে প্রাণঘাতী গুলিতে আহত হয়ে সাইদের মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য ডিএমপির ডেমরা থানার তথ্য অনুযায়ী, পূর্বশত্রুতার জেরে ডেমরার ওরিয়েন্টাল স্কুলের পাশে ২০-২৫ জনের মারধরে সাইদের মৃত্যু হয়। পরদিন এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলাও হয়েছে।
শহীদদের প্রজ্ঞাপনে ৬৭৭ নম্বরে থাকা নামটি গাড়িচালক মো. শাহীন হাওলাদারের (৪০)। তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২৫ আগস্ট (২০২৪) আহত হওয়ার ১০ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। শাহীনের স্ত্রী রিক্তা বেগম বলেন, ঢাকার সচিবালয়ের সামনে আনসার আন্দোলনের সময় মারধর ও আঘাতে আহত হয়ে মারা যান তাঁর স্বামী।
শেখ হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট (২০২৪) বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত হওয়া ৩৫ জনের নাম এসেছে জুলাই শহীদের তালিকায়। তাঁদের মধ্য থেকে ২৭ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকেই স্বজনদের আগুনে পুড়ে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।
জুলাই শহীদদের সংজ্ঞায় গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ওই সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের আক্রমণে মৃত্যুবরণকারীদের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগের বাড়ি বা তাঁদের মালিকানাধীন স্থাপনায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁরা শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন? জেলা প্রশাসন ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, শহীদদের সংজ্ঞা অনুযায়ী এঁদের নাম তালিকায় দেওয়ার সুযোগ নেই।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে নাম থাকা নাটোরের চার ব্যক্তির পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের স্বজনের মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। এই চারজন হলেন মিকদাদ হোসেন খান (প্রজ্ঞাপন নম্বর-২৮৯), মো. শরিফুল ইসলাম মোহন (২৯০), ইয়াসিন আলী (২৯১) এবং মো. মেহেদী হাসান (২৯২)। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট নাটোরের একটি বাসায় আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই তাঁরা মারা যান।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, এই চারজন নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে নিহত হন।
লালমনিরহাটের ছয় ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁদেরও মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। তাঁরা হলেন আল শাহ রিয়াদ (প্রজ্ঞাপন নম্বর-৭১৩), মো. জোবায়ের হোসেন (প্রজ্ঞাপন নম্বর ৭১৪), মো. শাহরিয়ার আল আফরোজ শ্রাবণ (নম্বর ৭১৫), মো. জাহিদুর রহমান (৭২৯), মো. রাজিব উল করিম সরকার (নম্বর ৭৮২) ও মো. রাদীফ হোসেন রুশো (৭৮৩)।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই তাঁদের স্বজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিয়াদের মা নাজনিন পারভীন, জোবায়েরের বাবা মো. জহিরুল ইসলাম, শ্রাবণের বাবা মো. সাইদুর রহমান, জাহিদুরের বোন খুশি, রাজিবের বাবা মো. রেজাউল করিম সরকার এবং রাদীফের বাবা মো. জিয়াউর রহমান।
ঘটনার পরপর গণমাধ্যমে আসা তথ্য ও পুলিশের ভাষ্য, লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত হন এই ছয়জন।
রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সূত্র বলছে, বরগুনার আমতলীতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রজ্ঞাপনে ২৮৬ নম্বরে থাকা মো. আল–আমিন হোসেনের (২৬)। পুলিশ জানিয়েছে, ৫ আগস্ট (২০২৪) বরগুনার মেয়রের বাসায় অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন আল–আমিন। তাঁর বাবা মো. আনোয়ার হোসেন জানান, অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ১২ দিন পর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মৃত্যু হয় আল-আমিনের।
শহীদদের তালিকায় নাম এসেছে যশোরে হোটেল জাবিরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় নিহত ২৩ জনের। হোটেলটির মালিক যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার।
নিহত এই ২৩ জনের মধ্যে ১৬ জনের পরিবারের অনেকেই দাবি করেছেন, আগুন দিতে গিয়ে নয়, বরং নেভাতে গিয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, নিহত ব্যক্তিরা আন্দোলনে ছিলেন। এ জন্য প্রজ্ঞাপনে তাঁদের নাম থাকা দোষের নয়।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এঁদের মৃত্যু হয়েছে, তা সঠিক। তবে নিহত ব্যক্তিরা আন্দোলনে ছিলেন। সেই হিসেবেই শহীদের প্রজ্ঞাপনে তাঁদের নাম এসেছে। তিনি বলেন, এর বাইরে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফিরোজ আহমেদের মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। বিশেষ বিবেচনায় শহীদদের তালিকায় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল।
জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম আরও বলেন, যেহেতু তাঁদের মৃত্যু নিয়ে কথা এসেছে, এ জন্য যাচাই-বাছাই করে তাঁদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, পিআইও ফিরোজ আহমেদের (প্রজ্ঞাপনে নম্বর ৭৯৭) মৃত্যু হয় যশোর সদর থানা এলাকার একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগের কারণে।
আইনের সংজ্ঞার বাইরে কারও নাম তালিকায় ঢোকানোর সুযোগ আছে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীর কাছে। তিনি বলেন, জুলাই শহীদদের ব্যাপারে আইনে যেভাবে, যে ভাষায় বলা আছে, ঠিক সেভাবেই শহীদের ব্যাখ্যা দিতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জুলাই শহীদদের প্রজ্ঞাপনে চার পুলিশ সদস্যের নাম এসেছিল। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের খলিলুর রহমান তালুকদারের নাম (প্রজ্ঞাপন নম্বর ২২৯) বাদ দেওয়া হয়েছে। এখনো তিনজনের নাম রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে ৮১ নম্বরে থাকা ঢাকার বনানীর মো. শহিদুল আলমের (৪২) স্ত্রী, ১৬০ নম্বরে থাকা ময়মনসিংহের ভালুকার মোহাম্মদ মোকতাদীরের (৫০) ভাই এবং ৪৫৬ নম্বরে থাকা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মো. মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়ার শ্যালক বলেছেন, এই তিনজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। শহিদুল গত বছরের ৫ আগস্ট উত্তরায়, মোকতাদীর ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে এবং মাসুদ ১৯ জুলাই রামপুরায় নিহত হন।
এর বাইরে প্রজ্ঞাপনে ৩৭৪ নম্বরে থাকা খুলনার খালিসপুরের মো. রবিউল ইসলামের সম্পর্কে পুলিশের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে উত্তরা হাউস বিল্ডিং পুলিশ বক্সের সামনে ছাত্র-জনতার মারধরে তিনি নিহত হন। স্বজনেরাও একই তথ্য জানান।
রবিউলের বিষয়ে গণমাধ্যমের খবরে তখন বলা হয়েছিল, তিনি হাউস বিল্ডিং এলাকায় পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করছিলেন। তাঁর ছোড়া গুলিতে এক শিশু আহত হয়। গুলি শেষ হয়ে গেলে তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন তাঁকে ধরে মারধর করা হয়। তাঁর লাশ গাছে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
শহীদের তালিকায় ৩৭১ নম্বরে থাকা মাদারীপুরের রাজৈরের সাওন মুফতীর (২৩) সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে তাঁর মৃত্যু হয়। সাওনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি ছাত্রলীগের পুরান ঢাকার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রসন্ন পোদ্দার লেন ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পুলিশের নথিও বলছে, সাওন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, শুরুর দিকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা পাওয়াসহ নানা কারণে কিছু নাম শহীদদের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। পরে আটজনের নাম বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনজনকে ফাউন্ডেশন পাঁচ লাখ টাকা করে দিয়েছিল। সেগুলো ফেরত চাওয়া হয়েছে।
ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কামাল আকবর বলেন, আন্দোলনে নিহত নয়, অথচ শহীদদের প্রজ্ঞাপনে নাম আছে এমন আরও আটজনের তথ্য অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে তাঁদের নাম এখনো বাদ দেওয়া হয়নি।
এদিকে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে, অথচ প্রজ্ঞাপনে নাম ওঠেনি এমন সাতজনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এই সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের পরিবারের প্রত্যেকেই দাবি করেছেন, এই ব্যক্তিরা গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন। পিবিআইয়ের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব নাম পাওয়া যায়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জালিয়াতি করে কাউকে শহীদ দাবি করা হলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জালিয়াতি করে শহীদ দেখিয়ে শুধু সহায়তা নেওয়া নয়, ওই সব নিহতের ঘটনায় মামলা করে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
যেমন লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত ছয় ব্যক্তির সহযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া আরমান আরিফ (২৭) নামের এক তরুণ ৯ মাস ২২ দিন পর গত মে মাসে এ ঘটনায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় ৭৩ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আসামিরা ছয়জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ করেন। পরে ওই বাড়িটির ভেতরে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যান। মামলাটিতে অন্তত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এক বছরেও শহীদদের তালিকাও নির্ভুলভাবে না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানিয়েছেন শহীদদের স্বজনেরা। তাঁরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ এই তালিকার কারণে পুরো প্রজ্ঞাপন নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।
শহীদ শাহারিয়ার খাঁন আনাসের মা সানজিদা খান বলেন, সবারই আশা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদেরা যেন সঠিক বিচার পায়। আর এই বিচারের জন্য শহীদদের নির্ভুল তালিকা থাকা দরকার। এক বছরে প্রকৃত শহীদের তালিকা হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, প্রকৃত শহীদেরাই যেন শহীদের তালিকায় স্থান পান।’
সূত্র : প্রথম আলো