গোলাম মাওলা রনির ‘মিথ্যাচার’ বনাম শফিকুলের ‘টুনটুনি ঝুনঝুনির বিবেকবুদ্ধি’

গোলাম মাওলা রনি রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মনোনয়নে নির্বাচনে অংশও নিয়েছেন। বিএনপি নেতা হিসেবে তার যতটা না পরিচিতি, তারচেয়ে বেশি পরিচিতি এখন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে। ইউটিউবে তিনি দিনে একাধিক ভিডিয়ো প্রকাশ করে থাকেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে কলাম লেখেন, টেলিভিশন টকশোতে যান, কথা বলেন অনেকটাই রাখঢাক না রেখেই।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশে সাবেক সরকারের সবকিছু মিথ্যা হয়ে গেছে। তাদের পক্ষে যায় এমন কিছু বলা নিষিদ্ধ। টেলিভিশনে হোক, গণমাধ্যমে হোক, সবখানে একতরফা প্রচারণা। এবং প্রচারণার একটাই ভাষা—খারাপের খারাপ আওয়ামী লীগ; তাদের আমলে ভালো কোন কাজ এমন একটাই নাই; তারা ফ্যাসিস্ট, তারা লুটপাট করেছে; তারা দেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে; ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি করেছে; তারা গণহত্যা চালিয়েছে জুলাই-আগস্টে; এমন কত কী!

এমন প্রচারণা সমানে চলছে। সরকার থেকে শুরু করে ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দলের ভাষা অভিন্ন। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে যারা আমন্ত্রিত অতিথি থাকেন, তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলতে, যারা আমন্ত্রণ জানান তারাও কথা বলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সব যেন সাজানো-গোছানো, এবং একপাক্ষিক।

আগে সরকারি ভাষা আর বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের ভাষা ছিল পৃথক। নাগরিক সত্তার ছিল পৃথক পরিচিতি; কিন্তু এখন সবাই বলে সরকারি ভাষায়। ভয় বুঝি একটাই—পাছে ফিরে আসে আওয়ামী লীগ! আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) যা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এখন সেখানে হচ্ছে রাজনৈতিক বিচার। চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন যে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, তিনি আগে ছিলেন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান আইনজীবী, এখন তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। ওই ট্রাইব্যুনালসহ অন্য আদালতে রাজনৈতিক বিচারের প্রধান আসামি শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হওয়া লোকেরা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক এবং এমন লোকও ছিলেন যারা প্রকাশ্যে ফেসবুকে শেখ হাসিনার ফাঁসি চেয়েছিলেন।

এই কথাগুলোর অবতারণা মূলত দেশ-পরিস্থিতি উল্লেখ করতে। সেই দেশে এখন সবাই ‘সরকারি ভাষায়’ কথা বলে। ব্যক্তিগত বিবেচনাবোধের লোপ পেয়ে যাওয়া সময়ে ইউটিউবে যে ক’জন লোক মাঝেমাঝে সত্য কথা বলার চেষ্টা করে থাকেন, তন্মধ্যে আছেন গোলাম মাওলা রনি। তিনি নিজেকে জুলাই আন্দোলনের একজন ভাবেন, বিশ্বাস করেন এবং প্রচারও করেন থাকেন; তবে মাঝেমাঝে একান্ত বাধ্য হয়ে অথবা বিবেকের তাড়নায় কিছু সত্যও বলে থাকেন। সত্য বলতে গিয়ে আবার সতর্ক থাকেন যাতে কথাগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে না যায়! এই সত্যের মধ্যে একটা অন্যতম সত্য হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে নিয়ে মন্তব্য। এটা নিয়ে রনি ও শফিকুল এখন মুখোমুখি অবস্থানে। চলছে পাল্টাপাল্টি কথামালা।

গোলাম মাওলা রনি ও শফিকুল আলমের সাম্প্রতিক বাগযুদ্ধ রনির একটা টেলিভিশন টকশোকে কেন্দ্র করে। সাবেক এই সংসদ সদস্য নিয়ে অনেকটাই বিব্রত সরকার এবং শফিকুল আলম, এটা অনেকদিন ধরে নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শহিদ নূর হোসেন নিয়ে একটা মন্তব্যের জেরে এবারের এই প্রকাশ্য বিরোধের সূত্রপাত।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ৪ জুলাই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে দাবি করেন, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি টকশো ও ইউটিউবে মিথ্যাচার করছেন। ফেসবুক পোস্টে শফিকুল আলম বলেন: “গোলাম মাওলা রনি টিভি টকশো এবং ইউটিউব ভিডিয়োগুলোতে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের একটি প্রধান উৎস। তিনি সময় টিভির একটি টকশোতে দাবি করেছেন যে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নায়ক নূর হোসেনকে মব হত্যা করেছিল। অথচ, আমরা সবাই জানি যে, নূর হোসেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর জেনারেল এরশাদের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তিনি কি এরশাদের অপরাধগুলো ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ভূমিকা নিয়েছেন? টকশোতে আরেকটি দুঃখজনক বিষয় ছিল যে, সময় টিভির উপস্থাপক রনির মিথ্যা ছড়ানোর কোনো প্রতিবাদ করেননি। যখন আপনি বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বরকে প্রশ্রয় দেন, তখন আপনি আসলে তাদের অপরাধের সহযোগী হয়ে ওঠেন!”

শফিকুল আলমের এই স্ট্যাটাসের জবাব একইদিনই দিয়েছেন গোলাম মাওলা রনি। তিনি শফিকুল আলমের একটা ছবি পোস্ট কর ফেসবুকে লেখেন: “ছবির ভদ্রলোকের একটি নাম আছে। কিন্তু তার নামের সঙ্গে হাল আমলে এমন এক উপাধি যুক্ত হয়েছে যা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানুষের মন মস্তিষ্কে কিয়ামত পর্যন্ত ঘুরপাক খাবে! এই ধরনের লোকদের সম্পর্কে আমি সাধারণত কথা বলি না। কিন্তু রাষ্ট্রের হয়ে তিনি এমন কিছু করছেন এবং এমন কিছু বলছেন যার প্রতিবাদ করা নাগরিকদের জন্য ফরজে আইন। আর তাই একটি টেলিভিশন টকশোতে বলেছিলাম—ইউনূস সরকারকে ডুবানোর জন্য বাইরের কারো দরকার নেই, এই লোকটিই যথেষ্ট!

আমার কথা শুনে নিশ্চয়ই লোকটির মাথা গরম হয়েছে এবং সেই গরমে তার মাথার বুদ্ধি প্রসারিত হয়ে শরীরের টুনটুনি ঝুনঝুনিতে ছড়িয়ে পড়েছে! তিনি আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন এবং শহিদ নূর হোসেনকে নিয়ে আমি যে মন্তব্য করেছি তা তার ঝুনঝুনির বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করেছেন।

মব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি বলেছি নূর হোসেন এরশাদ জমানায় মবের শিকার হয়ে শহিদ হয়েছেন। মব যার ইংরেজি নাম জঙ্গল জাস্টিস তা কেবল জনগণ করে না, রাষ্ট্রীয় বাহিনীও করে। এই সোজা বিষয়টি অনুধাবনের জন্য লোকটির ঝুনঝুনিতে কয় মণ তেল মালিশ করতে হবে তা যদি কেউ আমায় বলে দেন তবে খুবই উপকার হয়।”

সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদা ভোগ করা শফিকুল আলম প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। মুখপাত্র না থাকা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে তিনিই ভূমিকা রাখেন। যদিও এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত, তবু তিনি এসব করে থাকেন। সেই শফিকুল আলমের বিবেচনাবোধকে গোলাম মাওলা রনি ‘টুনটুনি ঝুনঝুনির বিবেকবুদ্ধি’ আখ্যা দিয়েছেন। বিষয়টা অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ নিশ্চিতভাবেই। তবে গোলাম মাওলা রনির কথা বলার মধ্যে যে রসবোধের প্রকাশ, এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবকে একেবারে শিশুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন।

যদিও অশ্লীল ইঙ্গিতের, তবুও বলি—‘টুনটুনি ঝুনঝুনি’ বলতে আমরা সাধারণত শিশুদের লৈঙ্গিক পরিচিতির ইঙ্গিতকে বুঝে থাকি। কিন্তু শফিকুল আলম তার অবস্থান ভুলে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘শিশুতোষ’ আচরণ করলেও আদতে তিনি শিশু নন। তবে গোলাম মাওলা রনি তাকে সেই পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই অশ্লীল ইঙ্গিতের হলেও এখানে আছে ‘স্যাটায়ার ও উইট’ (Satire & wit)।

গোলাম মাওলা রনির লেখালেখি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় তিনি বেশ পড়াশোনা করে থাকেন। তার লেখালেখি ও কথাবার্তায় এই ‘স্যাটায়ার ও উইট’-দেখা মেলে। এই স্যাটায়ার ও উইট মূলত হাস্যরসের রূপ। শফিকুল আলমের বিবেকবুদ্ধি নিয়ে আলোচনা তার কাছে স্যাটায়ার, আর ‘টুনটুনি ঝুনঝুনি’ মূলত উইট যা আরও সূক্ষ্ম এবং বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস। এই ‘টুনটুনি ঝুনঝুনি’ অশ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে একে সাহিত্যরূপ দিয়ে সূক্ষ্ম বিনোদন দিয়েছে সবাইকে।

এখানে হয়ত গোলাম মাওলা রনির পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে রয়েছে সেন্স অব হিউমার। এদিকে শফিকুল আলম কি বাদ রেখেছেন? একজন সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদা ভোগ করা প্রেস সচিব গোলাম মাওলা রনির সমালোচনা করতে গিয়ে মিডিয়ার লোকজন কেন প্রতিবাদ করল না—এই প্রশ্ন তুলেছেন। যা ফ্যাসিজমের আরেক রূপ নয় কি? রনি যেখানে শৈল্পিক, শফিকুল সেখানে আগ্রাসী; পার্থক্য কিন্তু পরিস্কার।

সরকার সবখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মিডিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে। দেশের কোন মিডিয়া সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না, অথবা করে না। প্রায়ই মিডিয়া থেকে প্রকাশিত সংবাদ কিছুক্ষণের মধ্যে হাপিশ হতে দেখা যায়। এই মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে-করতে সরকারের লোকজনেরা কি তবে অন্ধ-বধির-নির্বাক হয়ে থাকা সময়ে মাঝেমধ্যে যে কজন লোক সামান্য হলেও কথা বলার চেষ্টা করে থাকেন, তাদের মুখও কি বন্ধ করে দিতে চায়?

৪ জুলাই ২০২৫
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

Tags :

Kabir Aahmed

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025