ঢাকা, বাংলাদেশ – ২১ জুলাই, ২০২৫: ঢাকার জনবহুল উত্তরা এলাকায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) একটি F-7 BGI প্রশিক্ষণ জেট বিধ্বস্ত হয়েছে। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জন নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন, যা দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এটি বাংলাদেশে চতুর্থ F-7 বিমান দুর্ঘটনা, যা চীনের তৈরি এই যুদ্ধবিমানগুলোর নির্ভরযোগ্যতা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে।
পূর্বে বাংলাদেশে এফ-৭ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাগুলো:
- ৮ এপ্রিল, ২০০৮: টাঙ্গাইল জেলায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিধ্বস্ত হয়, যার ফলে স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ হাসান মারা যান।
- ২৯ জুন, ২০১৫: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ (বিএএফ) তার এফ-৭এমবি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হওয়ার পর নিখোঁজ হন।
- ২৩ নভেম্বর, ২০১৮: প্রশিক্ষণ চলাকালীন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দীপু (বিএএফ) তার এফ-৭বিজি বিধ্বস্ত হয়ে মারা যান।
জনসাধারণের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা, যেখানে উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া একটি আগ্নেয়াস্ত্রের ম্যাগাজিন ও বুলেটসহ বিমানে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ঘটনা জননিরাপত্তার প্রতি সরকারের সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। একজন উপদেষ্টার নিরাপত্তা ত্রুটি থেকে শুরু করে একটি সামরিক জেট বিমানের স্কুলে বিধ্বস্ত হওয়া পর্যন্ত এই ধারাবাহিক শিথিলতা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের অধীনে গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলায় সক্রিয় শাসনের অভাবকেই তুলে ধরছে।
কেন এফ-৭ যুদ্ধবিমান বারবার বাংলাদেশে বিধ্বস্ত হচ্ছে?
এফ-৭ যুদ্ধবিমান বারবার দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
পুরোনো নকশা ও কম স্বয়ংক্রিয়তা: এফ-৭ বিজিআই সংস্করণটি আধুনিকীকরণ করা হলেও, এর মূল নকশা ১৯৫০-এর দশকের সোভিয়েত মিগ-২১-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি। আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোতে উন্নত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকলেও, এফ-৭ পরিচালনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ম্যানুয়াল নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
পাইলট দক্ষতা: এফ-৭ পরিচালনা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। পাইলটদের অসাধারণ দক্ষতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা জরুরি, বিশেষ করে যখন উচ্চ চাপের প্রশিক্ষণ মহড়ায় বিমানের সর্বোচ্চ সীমা পরীক্ষা করা হয়।
রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনাল চাপ: এফ-৭ বিমানগুলো পুরোনো হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ফ্লাইট যন্ত্রাংশগুলোর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে, যা যান্ত্রিক ত্রুটির ঝুঁকি বাড়ায়।
নিবিড় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম: এফ-৭ বিমানগুলো মূলত প্রাথমিক প্রশিক্ষণ বিমান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হলো, এই বিমান দিয়ে ঘন ঘন ফ্লাইট ও জটিল মহড়া চালানো হয়। প্রশিক্ষণের এই উচ্চ গতি এবং তীব্রতা স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়।
আবাসিক এলাকার উপর দিয়ে উড্ডয়ন: ঢাকার জন্য একটি অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকি?
আজ একটি জনবসতিপূর্ণ স্কুল এলাকায় এই ট্র্যাজেডি অবিলম্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে: একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ জেট কি ঢাকার আবাসিক এলাকার উপর দিয়ে উড়তে দেওয়া উচিত?
এর সোজাসাপ্টা উত্তর হলো, না। আন্তর্জাতিক বিমান নিরাপত্তা নীতি অনুযায়ী, ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলের উপর দিয়ে নিয়মিত নিচু উচ্চতায় সামরিক প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এর বেশ কিছু সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে:
সীমিত জরুরি অবতরণের সুযোগ: জরুরি পরিস্থিতিতে পাইলটরা সবসময় জনবসতিহীন এলাকায় অবতরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু শহরের উপর দিয়ে উড়ে গেলে এই গুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ বিকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যায়, যা পাইলটদেরকে উচ্চ ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়।
ব্যাপক বেসামরিক প্রাণহানি ও সম্পদের ঝুঁকি: আবাসিক এলাকার উপর দিয়ে উড়তে গিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটি বা পাইলটের সামান্য ভুলের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি এবং গুরুতর সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া প্রায় নিশ্চিত, যা আজকের মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা দেখতে পেয়েছি।
চরম শব্দ দূষণ: নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানগুলো অসহনীয় মাত্রার শব্দ দূষণ সৃষ্টি করে। এটি দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

প্রধান উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়বদ্ধতা: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। যদিও তিনি বিমান বাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রমে জড়িত নন, কিন্তু সরকার প্রধান হিসেবে তার চূড়ান্ত দায়িত্ব সুদূরপ্রসারী:
নীতি ও তদারকি: সামরিক কর্মী এবং বেসামরিক নাগরিক উভয়কেই সুরক্ষিত রাখে এমন শক্তিশালী নিরাপত্তা নীতি, কার্যকর অপারেশনাল প্রোটোকল এবং দায়িত্বশীল ক্রয় সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করার জন্য প্রফেসর ইউনূসকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
জবাবদিহিতা ও তদন্ত: তাঁর প্রশাসনকে অবশ্যই দ্রুত, স্বচ্ছ এবং ব্যাপক তদন্ত পরিচালনা করতে হবে। এর মাধ্যমে এফ-৭ বিমানের উপযুক্ততা এবং ফ্লাইট বিধিমালার পর্যাপ্ততা সহ সকল পদ্ধতিগত সমস্যা উন্মোচন করা জরুরি।
জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার: বারবার ঘটা এমন ঘটনা, যার চূড়ান্ত পরিণতি আজকের এই বিপর্যয়, জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে অবশ্যই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে, জবাবদিহিতা প্রদর্শন করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এমন ট্র্যাজেডি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে।
সামরিক ফ্লাইটের অনুমোদন: কে দায়ী এই দুর্ঘটনার জন্য?
সামরিক ফ্লাইটের পথ নির্ধারণ, যার মধ্যে প্রশিক্ষণ মিশনও রয়েছে, তা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) কমান্ড কাঠামোর হাতে থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি চূড়ান্তভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
- বিএএফ প্রবিধান: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট নিরাপত্তা প্রবিধান, সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ অঞ্চল এবং অনুমোদিত আকাশপথ (করিডোর) রয়েছে।
- এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) সমন্বয়: বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) যদিও সামগ্রিক আকাশসীমা পরিচালনা করে, তবে সামরিক ফ্লাইটগুলো তাদের নিজস্ব অঞ্চলের মধ্যে বা ট্রানজিটের জন্য এটিসির সাথে সমন্বয় করে থাকে।
- কমান্ডিং অফিসারদের ভূমিকা: একটি নির্দিষ্ট ফ্লাইটের পরিকল্পনা এয়ারবেসের কমান্ডিং অফিসার এবং প্রশিক্ষণ সুপারভাইজারদের দ্বারা অনুমোদিত হয়ে থাকে। সমস্ত প্রোটোকল যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা তারাই নিশ্চিত করেন।
উত্তরায় ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ জেট দুর্ঘটনা হয়তো প্রতিষ্ঠিত নিরাপত্তা পদ্ধতির মারাত্মক লঙ্ঘন, একটি অননুমোদিত ফ্লাইট রুট, অথবা জনবহুল এলাকার উপর দিয়ে ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়ার বিদ্যমান বিধিমালার মৌলিক ত্রুটির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জাতি এখন কেবল শোক ও সমবেদনা চায় না; তারা চায় সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, পূর্ণ জবাবদিহিতা এবং সকল নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ।