‘ও আমার স্বপ্নঝরা আকুল করা জন্মভূমি ‘—এই গানের প্রতিটি কথা যেন এক জাগ্রত জাতিসত্তার হৃদস্পন্দন, আত্মার স্বর। খান আতাউর রহমানের লেখা ও সুরে এই গানটি ছিল ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের সুচনা সঙ্গীত। যেটি মুক্তি পায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের দমন-পীড়নের এক নির্মম সময়ে।সেই সময় এই গান যেন এক গোপন প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের মনে। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু এই গান, এর সুর ও কথার আবেদন কি শুধু ইতিহাসে সীমাবদ্ধ? নাকি আজও এই গানে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই?
গানে ফুটে ওঠা ‘রক্তরাঙা সন্ধ্যাবেলা’, ‘আগুন মাখা সকালবেলা’, কিংবা ‘ষড় ঋতুর ঝলমল রূপ’—এসব কেবল প্রকৃতির রূপ বর্ণনা নয়, এগুলো বাংলাদেশের একটি জাতীয়তাবাদী আবেগের রূপক। সেই সময়ের মানুষদের কাছে এই গান ছিল আত্মপরিচয় ও মুক্তির আহ্বান। যা বাঙালির সংগ্রামী মনন ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সুরে সুরে প্রকাশ করেছিল। স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাব্দী পরেও এই গান আমাদের সামনে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলে।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ অনেকদূর এগিয়েছে। উন্নতি ঘটেছে অর্থনীতি, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও শিক্ষায়। তবে এই উন্নয়নের ছায়ায় রয়েছে আত্মকলহ, বৈষম্য, দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও গণতন্ত্রের সংকট। এই প্রেক্ষাপটে এই গানের বার্তা যেন একটি জবাবদিহির অনুরোধ হয়ে ওঠে।
‘তোমার ঐ বৃষ্টিধোয়া সবুজ পাতার মুখর কলকতা’– অথচ, আজ নদী দূষণ, বন নিধন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলো বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ছে। গানের প্রকৃতি আজ যেন হারাতে বসেছে। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এই গানটি যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলাদেশ শুধু একটি ভৌগোলিক সীমারেখা নয়, বাংলাদেশ এক আত্মত্যাগের ইতিহাস। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে যে আত্মত্যাগ আর রক্তের গল্প, সেই গল্প আজ কতটা সম্মানিত হচ্ছে? আমরা কি আজো সত্যিকারের সেই ‘পূণ্যভূমি’ গড়ে তুলতে পেরেছি, যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে? এই গান আজো আমাদের মনে করিয়ে দেয় জাতি গঠনের মূল শক্তি ভালোবাসা, ঐক্য ও মহান আত্মত্যাগের ইতিহাস।
একসাথে গান গেয়ে সঙ্গীত শিল্পী আব্দুল জব্বার, মাহমুদুন্নবী, নিলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন যে একতা ও সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছিলেন, তা আজ সমাজে অনেকটাই দুর্লভ। ধর্ম, রাজনীতি এবং সামাজিক মতভেদে বিভক্ত আমরা সেই গানের শিক্ষাকে কতটুকু আত্মস্থ করেছি? “তোমার এই ষড় ঋতুর ষড় রূপের ঝলমল, আমার এই অন্ধ চোখে জ্বালিয়ে দিল কী যে আলো”-এখানে প্রতিটি রূপ প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার সংযোগের কথা বলে। প্রশ্ন হলো, আজকের প্রজন্ম কি সেই আলো দেখতে পাচ্ছে? আমরা কি সেই আদর্শে বাংলাদেশ নির্মাণ করতে পেরেছি, যেখানে প্রতিটি নাগরিক গর্ব করে বলতে পারে ‘এই মাটি আমার জনম কালের পূণ্যভূমি’?আজকের সমাজেও যদি আমরা এই একতা, সহমর্মিতা ও দেশপ্রেমকে ধারণ করতে পারি তাহলেই গানটির মূল অর্থ পূর্ণতা পাবে।‘ এই মাটি আমার জনম কালের পূণ্যভূমি’—এই কথা বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে থাকা এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। এটি কেবল একটি গানের লাইন নয়, এটি একটি শপথ । সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ ‘জনম কালের পূণ্যভূমি’ হয়ে উঠুক প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়ে। জয় হউক মানুষের !
- গণমাধ্যমকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা