রংপুরের তারাগঞ্জে দলিত সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তিকে ‘ভ্যান চোর সন্দেহে’ পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে আটকের কথা জানিয়েছে সেখানকার পুলিশ। কিন্তু কেন এই ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যে।
নিহতরা হলেন- তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা রুপলাল দাস এবং তার একজন নিকটাত্মীয় মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস। এর মধ্যে রূপলাল দাস পেশায় মুচি এবং প্রদীপ দাস পেশায় ভ্যানচালক। তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক জানিয়েছেন, গণপিটুনিতে ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে আশা করছি।
স্থানীয়রা বলছেন, নিহত রূপলাল দাস তারাগঞ্জ বাজারে মুচির কাজ করতেন এবং এলাকায় তিনি ছিলেন খুবই পরিচিত মানুষ। তাদের মতে, সে কারণেই তাকে হত্যার প্রতিবাদে রবিবার তার মৃতদেহ নিয়ে তারাগঞ্জের প্রধান সড়ক অবরোধ করেন এলাকাবাসী।
রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর রবি দাস বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর ভ্যান চুরি ও মাদকসহ নানা বিষয় বলা হলেও তারা মনে করছেন ‘এটি পরিকল্পিত ছিল এবং অন্য কোনো কারণে’ ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে।
কিন্তু ‘অন্য কারণ’ সম্পর্কে বিস্তারিত আর কোনো কিছু তিনি না জানালেও ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, ভিন্ন একটি এলাকায় এ ধরনের ‘তাৎক্ষণিক ঘটনা’ সেখানকার মানুষজনকে বিস্মিত করেছে।
ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
পুলিশ, নিহতদের পরিবারের সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ঘটনাস্থলে পরে গিয়েছেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হলো, রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাসের বিয়ের আলোচনা হচ্ছিল মিঠাপুকুর উপজেলার এক পরিবারের সঙ্গে। রবিবার এ বিষয়ে দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার কথা ছিল। এ নিয়ে কথা বলার জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান নিয়ে কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুরে রূপলাল দাসের বাড়িতে যাচ্ছিলেন প্রদীপ দাস। কিন্তু তারাগঞ্জ উপজেলা সয়ার ইউনিয়নে এসে কুর্শা যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে তিনি রূপলাল দাসকে মোবাইলে কল দেন।
নূপুর দাস বলেন, জামাইবাবুকে (প্রদীপ দাস রূপলাল দাসের ভাগ্নী জামাতা) আনতে বাবা বের হয়ে যান। জামাইবাবুর ভ্যানেই তারা বাড়ির দিকে আসছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্যান কাজীরহাট সড়কের বটতলা নামক একটি জায়গায় এলে কয়েকজন তাদেরকে থামান এবং এরপরই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে, যাতে দুজনই গুরুতর আহত হয়ে প্রাণ হারান।
স্থানীয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ঘটনার সময় প্রথমে জমায়েত হওয়া ব্যক্তিরা রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে ‘ভ্যান চোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। রূপলাল দাস এ সময় তাদের বিষয়ে জানার জন্য বারবার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বা মেম্বারকে কল দিতে বলেন। কিন্তু জমায়েত হওয়া ব্যক্তিরা তাতে কান দেয়নি।
ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে এসেছে। সেখানেও দেখা গেছে রূপলাল দাস হাতজোর করে প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন।
স্থানীয় একজন বলেন, তিনি (রূপলাল দাস) বার বার বলছিলেন আমি চোর না, আমি ডাকাত না। আমি জুতা সেলাই করি।
এর মধ্যেই আরও লোকজন জমায়েত হয়ে তাদের গণপিটুনি দিতে শুরু করে এবং মারতে মারতেই বুড়িরহাট স্কুলের মাঠে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা জ্ঞান হারালে হামলাকারীরা চলে যায়। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পরই চিকিৎসকরা রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। আর পরদিন সকালে মারা যান প্রদীপ দাস।
তাদের মৃত্যুর খবরে কুর্শা ইউনিয়নের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে মৃতদেহ নিয়ে সেখানকার মানুষ তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়ক অবরোধ করে ও মানববন্ধনে অংশ নেয়।
দলিত সম্প্রদায়ের রংপুর বিভাগীয় সভাপতি মনিলাল দাস বলেন, এ হত্যার প্রতিবাদে যে প্রতিবাদ ও বিশাল মানববন্ধন হয়েছে সেটিই প্রমাণ করে ভ্যান চুরির যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটি মোটেও সঠিক নয়।
কিন্তু ভ্যান চুরির প্রসঙ্গ কিভাবে এলো— এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কিছুদিন ধরেই ভ্যান চুরির ইস্যুটি এলাকায় আলোচিত ছিল। এর কারণ হলো জুলাইয়ের শেষ দিকে সেখানে একটি শিশু হত্যা ও ভ্যান চুরির একটি ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। রূপলাল ও প্রদীপ দাসের ভ্যান বটতলা এলাকায় আসার পর কয়েকজন ভ্যান ঘিরে ধরে। তারা ওই ভ্যানে রাখা একটি বস্তা থেকে কয়েকটি বোতল বের করে এবং এসব বোতলে চোলাই মদ রাখার অভিযোগ করে।
প্রসঙ্গত, দলিত সম্প্রদায়ের অনেকে নিজেদের ঘরে তৈরি চোলাই মদ সেবন করে থাকেন। এটি এই সম্প্রদায়ের অনেকে স্বাভাবিক জীবনাচরণের অংশ বলেও মনে করে থাকেন।
ভ্যানের বোতলে থাকা তরল পদার্থের ঘ্রান নিয়ে কয়েকজন তাৎক্ষণিক অসুস্থ বোধ করার দাবি করলে উপস্থিত অন্যরা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে।
তবে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, রূপলাল ও প্রদীপ দাসের ভ্যান বটতলায় পৌঁছার আগে সেই ভ্যানে তিনজন নারী ছিলেন। বটতলায় আসার পর তিন নারী ভ্যান থেকে নেমে যান এবং এরপর তারাই কাছে থাকা স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলার পর লোকজন ভ্যানটি ঘিরে ধরে ‘ভ্যান চুরি’ ও ভ্যানে চোলাই মদ রাখার অভিযোগ করে মারতে শুরু করেন।
পরিবার ও স্থানীয়রা যা বলছেন
নিহত রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাসের দাবি, এই ঘটনার সাথে চুরি, ছিনতাই কিংবা মাদকের কোনো সম্পর্কই নেই। বাবাকে এই এলাকার সবাই চিনে। চুরি, ছিনতাই বা মাদক হলেও এতো রাতে একটা গ্রামে এত লোক জমায়েত হয়ে দুজনকে এভাবে মেরে ফেলবে?
তিনি জানান, ভ্যান চুরির সন্দেহের কথা বলা হচ্ছে। অথচ ভ্যানটা তার জামাইবাবুর। তিনি বলেন, জামাইবাবুকে রিসিভ করে আনার জন্যই বাবা গিয়েছিল। যা বলা হচ্ছে এগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখানে অন্য কারণ থাকতে পারে। আগেও বাবাকে হুমকি দিয়েছিল কিছু লোক। তারও হয়তো শত্রু ছিল, যা আমরা জানি না।
নিহত রূপলাল দাস যে ইউনিয়নের অধিবাসী, সেই কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য মো. কাজী মনির উদ্দিন। তিনি বলেন, নিহত রূপলাল তারাগঞ্জে মুচির কাজ করতেন এবং তিনি তাদের পরিচিত ছিলেন। আমি যতটা জানি লোকটা ভালো ছিল। এখন কেন অন্য এলাকায় এই ঘটনা ঘটলো তা আমরা বুঝতে পারছি না।
আবার ঘটনা যেখানে ঘটেছে, সেটি উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। সেই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মিতাউর রহমান বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে তারাগঞ্জ বাজারেই মুচির কাজ করে আসছিলেন রূপলাল দাস। তাকে অন্যায়ভাবে মারা হয়েছে। আমার মনে হয় চুরির অভিযোগ ঠিক নয়। লোকজনের কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে সন্দেহের বশে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে পুলিশ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছেন মনিলাল দাস। তিনি বলেন, রূপলাল দাসকে ভালো মানুষ হিসেবে জেনে আসছিলাম আমরা। নিহত দুজনই বংশানুক্রমিক দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। এভাবে তাদের মেরে ফেলা মেনে নেয়া যায় না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে পুলিশের হাতে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে মেরে ফেলে চলে গেছে হামলাকারীরা। তাই এর প্রকৃত কারণ পুলিশকেই খুঁজে বের করতে হবে।
তারাগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক বলছেন, এ ঘটনায় নিহত রূপলাল দাসের স্ত্রী মামলা করেছেন। ইতোমধ্যে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। চারজনকে আটক করেছি। আশা করছি জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে হত্যার কারণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা