ডিয়েগো ম্যারাডোনা: ফুটবলার থেকে হয়ে ওঠা ‘ঈশ্বর’

ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। মৃত্যু তাকে পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে নিলেও ভক্তদের হৃদয়ে তিনি কখনো মরেননি। গতকাল ৩০ অক্টোবর ছিল এই ফুটবল জাদুকরের জন্মদিন। এদিন পৃথিবী আবারও স্মরণ করেছে সেই মানুষটিকে- যিনি শুধু ফুটবল খেলেননি, বরং ফুটবলকে নতুন করে সংজ্ঞা দিয়েছেন।

যেখানে অন্যরা ফুটবল খেলতেন পেশা হিসেবে, সেখানে ম্যারাডোনা খেলতেন আবেগ দিয়ে, বিদ্রোহ দিয়ে, শিল্প দিয়ে। মাঠে বল পা ছুঁয়ে নাচলে মনে হতো— এ যেন কোনো মানু্ষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার এক দরিদ্র উপশহর ভিয়ার ফিয়োরিতোয় জন্ম এক কিশোরের, যে কিশোর বড় হয় অনাহারে। কিন্তু পেটের ক্ষুধার চেয়ে বড় ছিল তার গোলের ক্ষুধা। মাটির মাঠে ছেঁড়া বল ঘুরিয়ে সে প্রমাণ দিচ্ছিল, প্রতিভা কখনো জন্মসনদ দেখে আসে না।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে অভিষেক, ১৭ বছরেই জাতীয় দলের জার্সি আর ২৫ বছর বয়সে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ একক পারফরম্যান্স। ম্যারাডোনা হয়ে উঠেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’।

১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে তার দুটি গোল— একটি হাতে, অন্যটি পায়ে, যা আজও মানুষের চোখে ভাসে। প্রথমটি ‘হ্যান্ড অব গড’, আর দ্বিতীয়টি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। একই ম্যাচে প্রতারণা ও পরিপূর্ণতা, পাপ ও পরমসৌন্দর্য— সব একসঙ্গে যেন ফুটবল নামের নাটকের চূড়ান্ত দৃশ্য।

এরপর সেমিফাইনাল ও ফাইনাল জিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। রোমের কলোসিয়ামের মতো মেক্সিকো সিটির আজটেকা স্টেডিয়াম সাক্ষী ছিল— একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে নিজের দেশের জন্য দেবতা হয়ে ওঠে।

যখন ইউরোপে তাকে অবহেলা করেছিল বড় ক্লাবগুলো, তখন ইতালির এক গরিব শহর নেপলস তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল। নাপোলিকে এনে দিয়েছিলেন সিরি-আ এর প্রথম শিরোপা, ইউরোপিয়ান গৌরব। আজও নেপলসে তার ছবি ঘর, দোকান, চার্চে টাঙানো। তিনি যেন ফুটবলার নন, তিনি এক আধুনিক সাধু।

ম্যারাডোনা শুধু খেলোয়াড় নন, দক্ষিণ বনাম উত্তর, দরিদ্র বনাম ক্ষমতাবান— এই সামাজিক লড়াইয়ের প্রতীকও ছিলেন। তার জীবন নিখুঁত ছিল না। মাদক, রাজনীতি, বিতর্ক সবই ছিল। কিন্তু ম্যারাডোনা কখনো অভিনয় করেননি। ভালোবাসলে তিনি উন্মুক্তভাবে ভালোবাসতেন, ভুল করলে সোজাসুজি মুখোমুখি হতেন। হয়তো এজন্যই মানুষ তাকে এখনো ভালোবাসে, কারণ তিনি ছিলেন ‘খাঁটি মানুষ’— ত্রুটিসহ, দীপ্তিসহ।

২০২০ সালের নভেম্বরে যখন খবর এল— ম্যারাডোনা আর নেই, তখন সারা পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। আর্জেন্টিনায় তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক, নেপলসে চোখের জল, নাপোলির স্টেডিয়ামের নতুন নাম—“স্টাদিও ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা।”

কিন্তু মৃত্যু তাঁকে মুছে দিতে পারেনি। আজও যখন কোনো কিশোর গলির মাঠে বলে জাদু দেখায়, মানুষ বলে— “দেখে মনে হচ্ছে ম্যারাডোনা ফিরে এসেছে।”

ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন— “যদি আমি মরে যাই, আমি চাই আমাকে মানুষ ফুটবলের জন্যই মনে রাখুক।” আজ সত্যিই মনে হয়, পৃথিবীর প্রতিটি বল, প্রতিটি গোল, প্রতিটি ফুটবল প্রেমীর নিঃশ্বাসে তিনি আছেন।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025