ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু পিতা-পুত্র আটক, কী ঘটেছিল?

লালমনিরহাট জেলার সদর থানার গোশলা বাজার এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বী দুই ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে স্থানীয় একদল ব্যক্তি হেনস্থার পর পুলিশ ওই দুজনকে আটক করেছে।

তবে আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, চুল কাটানোর পর টাকা কম দেয়া নিয়ে তর্কের জের ধরে ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগ তুলে ওই দুজনকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্থা করা হয়েছে।

ওই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে পিতা ও পুত্র এবং তারা পেশায় নরসুন্দর, যা বাংলাদেশে নাপিত হিসেবে পরিচিত। তারা দুজনে দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে একটি সেলুন পরিচালনা করে আসছিলেন।

লালমনিরহাট জেলার সদর থানা পুলিশ বলছে, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করে একদল ব্যক্তি পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে হেনস্থা করার পর তারা ওই দুই ব্যক্তিকে আটক করেছে।

পরেশ চন্দ্র শীলের পুত্রবধূ দিপ্তী রানী শীল জানান, তার শ্বশুর ও স্বামী সম্পূর্ণ নির্দোষ। তিনি বলেন, “তারা মিথ্যে অভিযোগ করেছে। আমার শ্বশুর আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে টাকা নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়েছিল তাদের মধ্যে।

এ ঘটনায় স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। ওই মসজিদের খতিব ও মামলার একজন সাক্ষী মো. জোবায়ের হোসেইন বলেন, “ওই দুই নাপিত নবীকে অসম্মান করে কথা বলেছেন। এর প্রত্যক্ষদর্শীও আছে”।

মামলার এজাহারে তাকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তিনি জানিয়েছেন, তিনি নিজে ও মামলার বাদী কেউই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন। তারা অভিযোগকারী ব্যক্তি ও অন্যদের কাছ থেকে ঘটনাটি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন।

তার দাবি, “ইমাম সাহেব মামলা করেছেন কারণ অভিযোগকারীর সাথে তার ইমাম-মুসল্লি সম্পর্ক আছে।

রবিবার এই হেনস্থা এবং আটকের ঘটনা ঘটলেও মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, ‘ধর্ম অবমাননা’র ঘটনাটি ঘটেছিল তিনদিন আগে শুক্রবার।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. সাজু মিঞা জানান, তারা ইতোমধ্যেই অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। যদিও গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে অনেকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অনেকগুলোতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ পরে আর প্রমাণ করা যায়নি।

বরং বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে এধরণের অভিযোগ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে এসব হামলার পটভূমি তৈরি করা হয়েছে।

কী ঘটেছে সেখানে

লালমনিরহাট থানায় ঘটনার যে প্রতিবেদন হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বালাটারী এলাকার মো. নাজমুল ইসলাম নামে এক তরুণ সেখানকার গোশলা বাজারে হানিফ পাগলার মোড়ে পরেশ চন্দ্র শীলের সেলুনে চুল কাটতে গিয়েছিলেন গত শুক্রবার।

মামলার অভিযোগে নাজমুল ইসলামের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে চুল কাটার সময় পরেশ চন্দ্র শীল তাকে নবী ও দাঁড়ি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন।

এর এক দেড় মাস আগে ১৭ বছর বয়সী আরেক কিশোরকেও পরেশ চন্দ্র শীল ওই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বলে মামলায় বলা হয়েছে।

পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, “পরে নাজমুল ইসলাম ও ওই কিশোর স্থানীয় মুসল্লি ও জনগণদের জানালে ২২ জুন দুপুর সোয়া দুইটায় মুসল্লি ও জনগণ ওই সেলুনে গিয়ে পরেশ চন্দ্র শীল ও বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে আটক করলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিক খবর পেয়ে পুলিশ ওই দুই ব্যক্তিকে হেফাজতে নেয়”।

এ সময় খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে বলে জানা গেছে। পরে এ ঘটনায় স্থানীয় আল-হেরা জামে মসজিদের ইমাম মো. আব্দুল আজিজ বাদী হয়ে পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

ওই মসজিদের খতিব ও মামলার একজন সাক্ষী জোবায়ের হোসেইন জানান, তারা স্থানীয়দের নিয়ে এ ঘটনার পর থানা ঘেরাও করেছিলেন।

ঘটনার তিন দিন পরে কেন লোকজন সেলুনে হামলা করলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার এবং সেদিন সবাই জুমার নামাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। পরে দুজনের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে মুসল্লি ও স্থানীয়রা রবিবার সেলুনে গিয়ে তাদের আটক করে। এরপর পুলিশ ওদেরকে তাদের হেফাজতে নিয়ে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।

পরিবার কী বলছে

পরেশ চন্দ্র শীলের পুত্রবধূ দিপ্তি রানী শীল বলছেন সোমবার তিনি তার শ্বশুর ও স্বামীর সাথে সাক্ষাত করেছেন। তিনি বলেন, “আমি আমার শ্বশুরের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন এ ধরনের কিছু হয়নি সেখানে। একটি ছেলে চুল কাটিয়ে টাকা কম দিয়ে যাচ্ছিল। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে ছেলেটি পরে দেখিয়ে দিবো বলে হুমকি দিয়ে চলে যায়।

তিনি বলেন, এরপর তারাই রোববার এসে দোকান ভাঙচুর করে এবং তার শ্বশুরকে মারধর করতে শুরু করলে তার স্বামী বাধা দেয়। পরে দুজনকেই মারধর করে পুলিশে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

অন্যদিকে ওই বাজারের আরও কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, চুল কাটার সময়ে ধর্ম নিয়ে আলাপচারিতার সরাসরি কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি।

পরেশ চন্দ্র শীল দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে সেলুন চালিয়ে আসছেন। সে কারণে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করে যা ঘটেছে সেটি অনেককে বিস্মিত করেছে।

যদিও জোবায়ের হোসেইন বলছেন, ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন তাদের পরিচিত আছেন। তারাও ঘটনা সম্পর্কে তাদেরকে নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশ পরিদর্শক সাজু মিঞা বলেন, অভিযোগ ওঠার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুজনকে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। এখন তদন্ত চলছে। স্থানীয় মুসল্লিরা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করেছেন। আশা করি তদন্তেই প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ওদিকে দিপ্তি রানী শীল অভিযোগ করেছেন, ওই ঘটনার পর তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তবে কারা এই হুমকি দিচ্ছে সেটি তিনি জানাতে পারেননি।

তিনি বলেন, “আমি জানি না তারা কেন হুমকি দিচ্ছে। তবে বাড়িতে থাকতেই ভয় পাচ্ছি এখন।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025