বৃদ্ধকে লাঠিপেটা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ

এই ছবিটা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধঃপতনের একটা চিত্র। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সদস্যরা ক্যাম্পাস থেকে গৃহহীন একজন বৃদ্ধকে লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দিচ্ছে মধ্যরাতে! আপনি ভাবতে পারেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এর ছাত্রদেরকে যে মানুষ করতে পারেনি সেকথা কি আর বাড়তি কোন উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে? এইরকম ছেলেদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্ররা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে! এটা বিশ্ববিদ্যালয়? এটা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? এখান থেকে ছেলেমেয়রা কি শিখছে? কি শিখবে?

আপনি ভাবতে পারেন অন্য কোন দেশে এইরকম একটা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের ছাত্র সংসদের নেতারা গৃহহীন একজন বৃদ্ধকে লাঠিপেটা করে ক্যাম্পাস থেকে তাড়াচ্ছে? অক্সফোর্ডে, ক্যামব্রিজে? হার্ভার্ডে? আচ্ছা, থাক, পশ্চিমা দেশের ঐগুলির কথা বাদ দিলাম। আপনি কি ভারতের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় বা জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় বা পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর এমনি শিলিগুড়িতে যে ইউনিভার্সিটিটা আছে সেখানেও এইরকম ঘটনা কল্পনা করতে পারেন? আচ্ছা ইন্ডিয়ার কথা বাদ দিলাম। আপনি ভাবুন তো পাকিস্তানের লাহোরে যে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি আছে, বা অন্যত্র অন্য যেসব ইউনিভার্সিটি আছে সেগুলিতেও কি এরকম ঘটনা ভাবতে পারেন?

না। কোন প্রপার বিশ্ববিদ্যালয়েই এইরকম ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক নয়। কেন? এইটা বলি, শোনেন। প্রথমে বলে নিই, বিশ্ববিদ্যালয় জিনিসটা কি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল কাজ হচ্ছে জ্ঞানচর্চা- অর্থাৎ জ্ঞান সৃজন করা আর জ্ঞান বিতরণ করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মানুষের অর্জিত জ্ঞান অধ্যয়ন করবেন, গবেষণা করবেন আর এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের বিকাশ করবেন আর সেইগুলি ছাত্র ছাত্রীদেরকে শেখাবেন। একটা পার্থক্যের কথা মনে রাখবেন, প্রশিক্ষণ আর জ্ঞানবিতরণ এই দুইটা এক জিনিস না। ইংরেজিতে বলে ট্রেইনিং আর এডুকেশন- এই দুইটা দুই জিনিস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাজ হচ্ছে জ্ঞান লাভ।

ছাত্ররা কিভাবে জ্ঞান অর্জন করে? ক্লাসরুমে পড়ে জ্ঞানলাভ এইটা তো আছেই। কিন্তু জ্ঞান অর্জন কিন্তু কেবল ক্লাসরুমেই হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নানারকম কর্মকাণ্ড হয়, রাজনীতি হয়, গান বাজনা হয়, শিল্প সাহিত্য খেলাধুলা এইসবও, দলাদলি তর্কাতর্কি এসব তো হয়ই, মাঝেমাঝে মারামারিও হয়। এই সবকিছু থেকেই ছেলেমেয়েরা শিখতে থাকে। বলা হয় যে ক্যাম্পাসের দেয়ালে লাগানো পোস্টার, ক্যান্টিন ক্যাফেটেরিয়ার আড্ডা এমনকি ক্যাম্পাসের হাওয়া বাতাস এইসব থেকেই নাকি ছাত্রদের মুল শিক্ষাটা হয়, যেগুলি ক্লাসরুমে মাস্টার মশায়দের দেওয়া পাঠকে পূর্ণ করে। দেখবেন যে কেমিস্ট্রি পড়ে যে মেয়েটা সে ফেমিনিজম নিয়ে লিখছে, একাউন্টিং পড়া ছেলেটা সিনেমা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে আর চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া ছেলেটা অন্যদেরকে সমাজতন্ত্র শেখাচ্ছে।

এইজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল হয়। কেননা জ্ঞান চর্চার মানেই তো হচ্ছে বিদ্যমান জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করা, বিদ্যমান প্রথা প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস এইসবকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা। মুখস্ত করলে তো সেটা জ্ঞান হচ্ছে না, খুব বেশী হলে সেটাকে প্রশিক্ষণ বলতে পারেন, জ্ঞান নয়। জ্ঞান চর্চা মানেই হচ্ছে এযাবৎ মানুষ যা শিখেছে সেইগুলিকে পরখ করা, আর অর্জিত জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ না করলে আপনি আর কিভাবে পরখ করবেন? যারা বিজ্ঞান পড়ে, ওরা বিদ্যমান গানকে পরখ করে ল্যাবে আর যারা সমাজবিজ্ঞান পড়ে ওরা চ্যালেঞ্জ করে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা- যারা সাহিত্য পড়ে ওরা, এবং যারা নাটক সিনেমা গান এইসব পড়ে, ওরাও- বিদ্যমান জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে পরখ করে।

জ্ঞানের এই চর্চার মধ্যেই ছেলেমেয়েরা ওদের পৃথিবীকে চিনতে পারে, সমাজকে চিনতে পারে, মানুষকে চিনতে পারে আর, ক্লিশে শুনালেও, ছেলেমেয়রা নিজেকে চিনতে শেখে; এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন একটা ছেলে বা মেয়ে স্নাতক হয়, সে আসলে জ্ঞানার্জন শিখে। জ্ঞানার্জন শিখে মানে কি? মানে হচ্ছে, স্নাতক হওয়ার অর্থ হচ্ছে পড়তে শেখা। বিশ্ববিদ্যালয় সন্দ প্রদান করে বলে দেয় যে এই ছেলেটা বা এই মেয়েটা এখন সমাজবিজ্ঞান পড়তে শিখেছে বা ইতিহাস বা রসায়ন বা অন্য যে কোন শাখায় জ্ঞানঅর্জন করতে শিখেছে।

এইজন্যে পৃথিবীর যে কোন ভাল বিশ্ববিদ্যালয়েই আপনি দেখবেন ছাত্র ছাত্রীরা খুব সংবেদনশীল হয়। গৃহহীন যারা থাকে সমাজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ছেলেমেয়েকে পাবেন যারা আপনাকে বলে দিতে পারবে একটা সমাজে মানুষ কেন গৃহহীন হয়, ধনী গরীবের বৈষম্য কেন হয়। কিছু ছেলেমেয়েকে পাবেন যারা বিদ্যমান সমাজ কাঠামো ভেঙে ফেলতে চায়, কিছু ছেলেমেয়ে পাবেন যারা মনে করে যে নৈরাজ্যের মাধ্যমেই নয়া সমাজ তৈরি হবে। কিছু ছেলেমেয়েকে দেখবেন বিচিত্র সব আইডিয়া, উদ্ভট সব থিওরি বলবে আপনাকে। এই সবকিছুই স্বাভাবিক। কিছু ছেলেমেয়ে তো থাকবেই যারা গৃহহীন দশার জন্যে গৃহহীন মানুষটাকেই দোষারোপ করবে। ওরা এইগুলি নিয়ে তর্ক করবে, কিন্তু কোন গৃহহীনকে মারতে যাবে না। কেননা জ্ঞানচর্চাতে গণতন্ত্র শিক্ষা হয়।

এইজন্যেই দেখবেন, কোন ক্যাম্পাসে যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি কোন অন্যায় করে ছেলেমেয়েরা তখন মানি না মানবো না বলে মিছিল করতে থাকে। ওদের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই, তবুও। কেন? কারণ নিজের অজান্তেই ওরা ক্যাম্পাসের হাওয়া বাতাস থেকেই এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শিখে যায়, যে, অপরের অধিকার রক্ষা মানেই আমার নিজের অধিকার রক্ষা। না, ঐসব মিছিলে নিশ্চয়ই সব ছেলেমেয়ে যায় না, কিন্তু কিছু ছেলেমেয়ে তো যাবেই। আর কেউ কেউ হতো বিরোধও করবে, কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধটা কোন না কোন জায়গায় ঠিকই বিরাজমান থাকবে। একটা গল্প বলি তাইলে, গল্প না, সত্যি ঘটনা।

কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে একটা বিস্ববিদ্যালের ক্যাম্পাসে একদিন সকাল বেলা একটা ছেলে পুরা ন্যাংটো হয়ে আসা যাওয়ার পথের ধারে একটা গাছে নিচে এসে বসেছে, হাতে একটা প্ল্যাকার্ড। ঘটনা কি? না, সেই ছেলেটা কি একটা ব্যাপারে প্রতিবাদ করছে, সেইজন্যে তাঁর এই দিগম্বর অবস্থান কর্মসূচী। অন্য ছেলেমেয়রা পথ দিয়ে হেঁটে যায়, ওর দিকে কেউ তাকায়, কেউ তাকায়ও না, কেউ হয়তো ওর পাশে এক মিনিট দাঁড়িয়ে সলিডারিটি জানায়। একদিন যায়, দুইদিন যায়, তিনদিনের দিন বা চারদিনের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর গার্ড পাঠিয়ে নাঙা ছেলেটাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে যেতে আসে। ব্যাস, এইবার দেখা গেল পঞ্চাশ ষাটজন ছেলেমেয়ে মিছিল বের করেছে যে না, ওকে জোর করে তাড়ানো যাবে না, প্রতিবাদ করা তো ওর অধিকার।

একটা বুড়া মানুষ, অশক্ত দরিদ্র। লোকটা ক্যাম্পাসের কোথাও কোন একটা ফুটপাতে রাতে ঘুমায়। আপনি ভাবুন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? কেউ ওকে একটু সাহায্য করতে চাইবে, কেউ ওর জন্যে একটা থাকার জায়গা ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করবে, কেউ এই দৃশ্যপটটা ওর কোন সৃজনশীল লেখায় বা ছবিতে জুড়ে দিবে, কেউ এইটা নিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা জোরালো করবে। কেউ কেউ হয়তো পুলিশেও খবর দিবে বা কর্তৃপক্ষকে বলবে যে এইসব গৃহহীন বাউন্ডুলেদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া হোক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সদস্যরা লাঠি নিয়ে ওকে পিটিয়ে তাড়াতে যাবে? না, এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কাছে প্রত্যাশিত না।

আর কেবল প্রত্যাশার ব্যাপারই তো নয়, এই কাজটা তো বৈধও নয়। ছাত্র সংসদের সদস্যরা কি দারওয়ান? নাকি পুলিশ? ওরা কেন লোকজনকে তাড়াতে বা মারধর করতে যাবে? ওদের তো সেই ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেয়নি। লাঠি নিয়ে বৃদ্ধ একটা মানুষকে পেটাবেন, এটা তো ফৌজদারি অপরাধ।

Tags :

Imtiaz Mahmood

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025