ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ মানেই যেন ইউরোপের একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০১২ সালের পর থেকে প্রতিটি শিরোপাই গেছে ইউরোপের কোনো না কোনো জায়ান্ট ক্লাবের হাতে। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, চেলসি কিংবা বায়ার্ন মিউনিখ—যেনো ফাইনাল মানেই ছিল ইউরোপের ক্লাবকে ঘটা করে শিরোপা তুলে দেওয়া।
কিন্তু ২০২৫ সালের নতুন ফরম্যাটে আয়োজিত ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ বদলে দিচ্ছে সেই দৃশ্যপট। এবার ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলো দেখাচ্ছে ব্যতিক্রমী পারফরম্যান্স। ইউরোপের ঘরানার ফুটবলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তারা ছিনিয়ে নিচ্ছে জয়।
গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের ফ্লামেঙ্গো-বোতাফোগো ও আর্জেন্টিনার রিভার প্লেট যেভাবে ইউরোপের বড় ক্লাবদের হারিয়েছে, তাতে করে দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব সমর্থকদের মনে জেগে উঠেছে এক নতুন স্বপ্ন—শিরোপা জয়ের স্বপ্ন।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৩২ দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত হচ্ছে এবারের ক্লাব বিশ্বকাপ। এই মঞ্চে ব্রাজিলের চারটি এবং আর্জেন্টিনার দুইটি—মোট ছয়টি ক্লাব দক্ষিণ আমেরিকা থেকে অংশ নিচ্ছে। এই ছয় দলের মধ্যে রয়েছে ব্রাজিলের পালমেইরাস, বোতাফোগো, ফ্লামেঙ্গো, ফ্লুমিনেন্স এবং আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স ও রিভার প্লেট।
প্রথম নয় ম্যাচে এই ছয় দলের কেউই হারেনি। ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজির বিপক্ষে বোতাফোগোর ১-০ গোলের জয় ও উয়েফা কনফারেন্স লিগজয়ী চেলসির বিপক্ষে ফ্লামেঙ্গোর ৩-১ গোলে দুর্দান্ত জয় দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের পুরনো ঐতিহ্যের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয়।
যদিও বায়ার্ন মিউনিখের কাছে বোকা জুনিয়র্সের হারের মাধ্যমে সেই অপরাজিত ধারা থেমেছে। তারপরও দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাবগুলো এবারের ক্লাব বিশ্বকাপে যেভাবে শুরু করেছে, তাতে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে তারা।
এমনটাই মনে করছেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লামেঙ্গোর কোচ ফিলিপে লুইস। লুইস বলেন, ‘এই পারফরম্যান্সে আমি নিজেই অবাক। তবে দক্ষিণ আমেরিকান দলগুলো ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে খেলতে অভ্যস্ত। তাই এরা যে কাউকে হারাতে সক্ষম।’
চেলসির বিপক্ষে গোল করে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড ব্রুনো হেনরিক। তিনি বলেন, ‘এটাই আমাদের সুযোগ দেখানোর যে আমরা ইউরোপিয়ান তারকাদের সঙ্গে সমানতালে লড়তে পারি।’
বোতাফোগোর হয়ে পিএসজির বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেন ইগর জেসুস, যিনি ইংলিশ ক্লাব নটিংহাম ফরেস্টের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ক্লাব বিশ্বকাপে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘নটিংহাম ফরেস্টে যাওয়ার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু আমি ক্লাব বিশ্বকাপে খেলার জন্য বোতাফোগোতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিই। সেটা সঠিক ছিল।’
বোতাফোগো কোচ রেনাটো পাইভা বলেন, ‘এটা শুধু একটি দলের নয়, এটা ব্রাজিলের সব কোচ ও খেলোয়াড়দের জয়। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের মান।’
এখন পর্যন্ত ফ্লামেঙ্গো, বোতাফোগো, পালমেইরাস ও রিভার প্লেট নিজেদের গ্রুপে শীর্ষে রয়েছে। ফ্লুমিনেন্সও শক্তিশালী বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সঙ্গে ড্র করে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আদায় করেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বোকা জুনিয়র্স, যারা বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে এখন গ্রুপ পর্ব উতরাতে কঠিন সমীকরণের মুখে।
২০১২ সালে শেষবার দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দল ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছিল। চেলসিকে হারিয়ে সেবার শিরোপার মুকুট পরেছিল করিন্থিয়ান্স। তারও অর্ধ যুগ আগে পর পর দুইবার শিরোপার স্বাদ পেয়েছিল ব্রাজিলের দুটি ক্লাব। ২০০৫ সালে লিভারপুলকে হারিয়ে সাও পাওলো আর পরের বছর বার্সেলোনাকে হারিয়ে ইন্টারন্যাসিওনাল। এরপর ইউরোপের ক্লাবগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে।
তবে এবার যেন পালা বদলের বার্তা দিচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকা। খেলা এখনো অনেক বাকি। তবে দক্ণি আমেরিকার ক্লাবগুলো যেভাবে সূচনা করেছে, এই সূচনাই জানিয়ে দিচ্ছে—লাতিন আমেরিকার ফুটবল প্রাণ আবার জেগে উঠছে। ফুটবল বিশ্ব এবার দেখার অপেক্ষায়— সেই প্রাণে সঞ্চার হয়ে দক্ষিণ আমেরিকা কি পারবে ইউরোপের দাপট থামাতে?