চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালগুলোতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) কাঠামোর আওতায় বর্তমানে চালু থাকা এনসিটি ও নতুন তিনটি টার্মিনালে জিটুজি ভিত্তিতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের সব প্রক্রিয়া দ্রুত এগোচ্ছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল এক বছর আগে থেকেই পরিচালনা করছে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান।
সোমবার লালদিয়া টার্মিনাল ও পানগাঁও টার্মিনাল নিয়ে নতুন চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। আগামী মাসে হতে পারে এনসিটি টার্মিনালের চুক্তি। চূড়ান্ত হয়ে আছে বে-টার্মিনালেরও ভবিষ্যৎও। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে বছরে ৩৩ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডেল করা চট্টগ্রাম বন্দরের ৬০ শতাংশ কনটেইনারই ভবিষ্যতে হ্যান্ডেল করবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। চুক্তির শর্তাবলি ‘গোপন’ রেখেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও টার্মিনাল অপারেটর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনা নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কেন এমন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি হচ্ছে– সেটাই বড় প্রশ্ন। বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাছাই করার আগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা উচিত বলেও তারা মনে করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘চুক্তির পুরো বিষয়টি তদারকি করছে মন্ত্রণালয়। সময়মতো মন্ত্রণালয় তা দেশবাসীকে অবহিত করবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে আছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) এবং রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) বা পতেঙ্গা টার্মিনাল। এনসিটি এখন পরিচালনা করছে নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ড্রাইডক। তাদের কাছ থেকেই এটি যাবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে।
পতেঙ্গা টার্মিনাল গত বছরের জুনে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল বা আরএসজিটিআইকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাকি দুটি অর্থাৎ, জিসিবি ও সিসিটিই কেবল দেশীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে। তবে সিসিটিও পরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে তিন গুণ বেশি সক্ষমতার আরও দুটি টার্মিনাল তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বে-টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনাল নামের দুটি নতুন টার্মিনালেরও তিনটি অংশ পরিচালনা করবে বিদেশি অপারেটর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানগাঁও টার্মিনালও।
ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আজ সোমবার লালদিয়া টার্মিনালের চুক্তি হবে বলে গতকাল এক আমন্ত্রণপত্রে জানিয়েছেন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক চৌধুরী। এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনটি নতুন টার্মিনাল তৈরি ও পরিচালনা বাবদ তিনটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ৩০০ কোটি ডলারের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে সরকার।
এনসিটি টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর এলেও তারা কত টাকা বিনিয়োগ করবে, তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে এনসিটিতে আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, লালদিয়ার চরের টার্মিনাল পরিচালনায় ডেনমার্কের এপি মুলার মায়ের্স্ক এবং বে টার্মিনাল প্রকল্পের একটিতে ডিপি ওয়ার্ল্ড, আরেকটিতে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনালকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড বর্তমানে এনসিটি টার্মিনাল পরিচালনা করছে। এদের কাছ থেকেই পরে দায়িত্ব নেবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে; বিদেশি অপারেটর এলে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যয় কতটা সাশ্রয়ী হবে; এসব বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করেনি সরকার। বন্দর কর্তৃপক্ষও মুখ খুলছে না।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিষয় জড়িত। তাই চুক্তির খসড়া, গ্যারান্টি, ইনডেমনিটি, টার্মিনেশন, পরিচালনা, ট্যারিফ বা পরিবেশ-সংক্রান্ত ধারাগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু কঠোর গোপনীয়তায় চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার।’
সিকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘চুক্তির শর্তাবলি প্রকাশ করে তার ওপর বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া উচিত। জানার অধিকার আছে জনগণেরও।’
এনসিটি ও পানগাঁও টার্মিনালের চুক্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে এনসিটিতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় সরকার। কনসালটেন্সি ফার্ম দরপত্র আহ্বানের পর ২৮ দিন সময় দেওয়া হবে।’
একই ব্যক্তি আছেন পানগাঁও টার্মিনালের চুক্তি প্রক্রিয়াতে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২২ বছরের জন্য বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে এই টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি অপারেটর যদি আমাদের দক্ষতা বাড়ায় ও খরচ কমায়, তাহলে তাদের স্বাগত জানাই।’
লালদিয়ায় টার্মিনাল যাচ্ছে ডেনমার্কের হাতে
চট্টগ্রাম বন্দর-সংলগ্ন পতেঙ্গার লালদিয়া চরে পণ্য ওঠানামার আধুনিক একটি টার্মিনাল নির্মাণে সব প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করে রেখেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতাধীন পুরো স্থান দখলমুক্ত করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় পতেঙ্গা ইনকনট্রেন্ড ডিপোর পাশেই এ টার্মিনালে বিনিয়োগের জন্য ডেনমার্কভিত্তিক শিপিং ও লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান এপি মোলার মায়ের্স্ক (এপিএম) ৮০০ মিলিয়ন বা ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে জানান বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এরই মধ্যে চরের ৬৪ একর জায়গাকে দুটি অংশে বিভক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠানটি এতে ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। তারা এটি পরিচালনা করবে ৩০ বছর।




