চিকেনস নেক’-এ অস্থিরতার কারণ ও বর্তমান পরিস্থিতি

বহুল চর্চিত ভারতের ‘চিকেনস নেক’ নিয়ে গত পনের মাসের ধুন্ধুমার বাদানুবাদের শুরু করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ভারতের মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারে বলেন―’ভারত আমাদের অশাস্ত করতে আসলে তাদের ‘সেভেন সিস্টার্স’ও অশান্ত হবে।‘ এর পরেই ‘সেভেন সিস্টার্স’ ও ’২২ কিলোমিটার চওড়া শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেনস নেক’ আলোচনায় উঠে আসে। এতে ঘৃতাগ্নি পড়ে ইউনূস তার ১৩টি বিদেশ সফর এবং দেশে বিদেশিদের সঙ্গে স্বাক্ষাতে সকলকে ‘দ্য আর্ট অফ ট্রায়াম্ফ (The Art of Triumph)’ নামক ক্যাটালগটি উপহার দিলে। এই ক্যাটালগে বাংলাদেশের যে মানচিত্র দেখানো হয়েছে সেখানে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’, ‘চিকেনস নেক’, মালদহ-মুর্শিদাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই বিতর্কীত ম্যাপটি বিশ্বময় প্রচার হওয়ার পরে ভারত নড়ে-চড়ে বসে।

গত পনের মাসে পাকিস্তানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেছেন। আসার হার এতটাই বেশি যা নিশ্চিতভাবেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেন এত ঘন ঘন পাকিস্তানি সামরিক কর্তাদের বাংলাদেশে আসতে হচ্ছে? এদের মধ্যে আইএসআই-কর্মকর্তারা তো ছিলেনই, সর্বশেষ পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা বাংলাদেশে এসেছেন এবং তাকে লালমনিরহাটের পরিত্যাক্ত বিমানবন্দরে, চিকেনস নেক সংলগ্ন অঞ্চলেও নেওয়া হয়েছে। ইন্টেরিম সরকার হঠাৎ করেই প্রায় ৮৪ বছর ধরে পরিত্যাক্ত লালমনিরহাট এয়ার বেসকে জঙ্গি বিমান ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে। টাকা ও নির্মানে সহায়তা করবে পাকিস্তান ও চীন। ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলো নীরবে গভীর পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে…. ।

আফগান-পাকিস্তান গুলি বিনিময়ের পরে দ্বিতীয় দফায় শান্তি আলোচনা হয়েছিল তুরস্কে। সেখানে আফগান কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে-আফগানিস্তানের দির ও চিত্রাল অঞ্চল, কোরার নদী, বাজর, খুররম, নর্থ ওয়াজিরস্তান সাউথ ওয়াজিরস্তান ওরাওয়ার্দি আফগানিস্তানের তথা টিটিপির কব্জায় থাকবে। পাকিস্তান যেন দ্রুত তাদের সৈন্য ও সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়। আফগানরা ভারতের সঙ্গে গভীর দোস্তির ফলেই যে এমন হুমকি দিচ্ছে তাতে ঘাবড়ে গিয়েই জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা বাংলাদেশে ছুঁটে এসেছিলেন ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ দিয়ে ভারতকে জব্দ করতে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আবেগসর্বস্ব কর্মকর্তাদের ‘ভারত দখলের’ বায়বীয় স্বপ্ন-খায়েশ দেখিয়ে উত্তেজিত করে চিকেনস নেক কব্জা করে ভারতের নর্থইস্টকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে।

সাহির মির্জার সফরেই পাকিস্তান-বাংলাদেশ মিলিটারি ফাউন্ডেশন বা প্যাক্ট ধরণের কিছু একটা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। এর অর্থ বাংলাদেশে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি ওয়ার’-এর ফার্টাইল গ্রাউন্ড হতে চলেছে! জিওপলিটিক্যালি এই ধরণের ডার্টি গেম পাকিস্তান খেলে অভ্যস্ত। তারা যেমন আহ্বান জানায়-ভারতকে, ইরানকে, আফগানিস্তানকে টাইট দিতে চাইলে আমাদের ল্যান্ড ইউজ করো… ‘পাইসা ফেকো আউর তামাশা লুটো’। সেভাবেই ইউনূস লালমনিরহাটে চীন ও পাকিস্তানকে অ্যাড করে ভ্যালু বাড়াতে চেয়েছেন।

ড, ইউনূসের প্ল্যান খুব সিম্পল। তিনি ভালো করে জানেন তার এইসব উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না। তার পরও তিনি ভারতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন-ভারতই আমাদের প্রধান শত্রু। তিনি জানেন ‘চিকেনস নেক’ বা ‘সেভেন সিস্টার্স’-এ হাত দিতে গেলে হাত পুড়ে যাবে। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড অ্যাক্টিভ হলে সেটা ফোর্ট উইলয়াম কলকাতা থেকে মিজোরাম পর্যন্ত এবং অরুণাচল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তার প্ল্যান তার ‘মাস্টার’-এর পরামর্শ মত আরও কিছু দিন পাওয়ারে স্টে করা। তাই ছলে-বলে-কৌশলে তিনি নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চান। দলগুলোর চাপে ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন’ বললেও তার মূল কথা গত বছর ক্ষমতা গ্রহণের পরেই বলেছিলেন- “আমি যখন দেখব সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, সকল সংস্কার শেষ হয়ে পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখনই নির্বাচন হবে।“

এখন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়লেও তিনি ঠেকানোর কৌশল অ্যাপ্লাই করেই যাচ্ছেন। ঘন ঘন পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের বাংলাদেশ সফর তারই অংশ। আইএসআইয়ের জন্য বাংলাদেশ এখন অবারিত। তিনি ‘চিকেনস নেক’-এ একটা ক্যাওয়াস বাঁধাতে চান, যাতে করে ভারত ছোট আকারে হলেও এখানে ইনভেড করে। আর তখনই তিনি বিশ্ববাসীকে ডেকে নালিশ ঠুকতে পারবেন। পাশাপাশি দলগুলোকেও নির্বাচনের ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে পারবেন। এ ছাড়া তার পক্ষে আর কিছু করার সক্ষমতা নেই।

ভারতীয় গোয়েন্দাদের বাংলাদেশ সফরের পরে ভারত ‘চিকেনস নেক’ সংলগ্ন চোররা, কিষাণগঞ্জ ও বামুনি অঞ্চলে ৩টি নতুন মিলিটারি গ্যারিসন তৈরি করেছে। পাশাপাশি গত ৬ থেকে ২০ নভেম্বর, ৪ থেকে ১৮ ডিসেম্বর ও ১ থেকে ১৫ জানুয়ারি তিনটি NOTAM জারি করেছে। একই সময়ে অরুণাচল প্রদেশজুড়ে অপারেশন ‘পূর্ব প্রচণ্ড প্রহার’ মহড়া চালু করেছে। এই সময়ে বিমান, গোলন্দাজ বাহিনী, মাউন্টেন ব্যাটালিয়ন কম্ব্যাট ট্রেইনিং, কোঅর্ডিনেটেড সর্টিস এন্ড লজিস্টিক ড্রিল মাল্টিপল বেস-এ পরিচালনা করবে।

পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোনো ভাতৃত্ব নতুন করে চেগিয়ে তুলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। সন্ত্রাসী শলা-পরামর্শ ছাড়া এক ‘ভিখিরির’ কাছ থেকে কী পেতে পারে? পাকিস্তানের লাহোরী জেনারেলরা যেমন পাবলিককে জোশে অন্ধ বানাতে আরব্য রজনীর মত গল্প ফাঁদে যে ‘হাজার বছর ধরে হিন্দুস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করব, কাশ্মীর দখল করব, দিল্লিতে ইসলামী ঝান্ডা ওড়াব’। ওই জেনারেলরা যেমন জানে; এসব ‘বাৎ কি বাৎ হাত্তিওকা দাঁত’, তেমিন ইউনূসও জানেন; কস্মিনকালেও তার ‘সেভেন সিস্টার্স’ ‘খেয়ে দেওয়ার খায়েশ’ পুরো হবে না, ‘চিকেনস নেক’ ব্লক করে ভারতকে জব্দ করার দুরভিসন্ধি কার্যকর হবে না, মুর্শিদাবাদ-মালদহ জুড়ে নিয়ে ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ গঠনের সিলসিলাও বাস্তবায়ন হবে না। তার পরও তার এই ক্যাওয়াস লাগানোর চেষ্টা থেমে নেই কারণ, তিনি তার ‘মাস্টারের’ কাছে ‘কমিটেড’।

প্রশ্ন উঠতে পারে ভারত এতবড় সামরিক শক্তিশালী দেশ হয়েও বাংলাদেশের ক্রমাগত প্রভোকেশন-এর জবাব দিচ্ছে না কেন? কেন মুখ বুজে সহ্য করছে? এর পেছনের কারণ খুঁজতে হলে ভারতের বিদেশ নীতি বুঝতে হবে। ভারত শত প্রভোকেশনেও প্রতিবেশী কোনও দেশে ইনভেড চালানো সমর্থন করে না। সম্প্রতি কাশ্মীরের পেহেলগাও-এ সন্ত্রাসী হামলার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন- “ভবিষ্যতে যেকোন জঙ্গি হামলাকে যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে”, তার পরও ভারত এইমুহূর্তে বাংলাদেশে হামলা করবে না তার টেকনিক্যাল কারণ শেখ হাসিনা। এই মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশে আক্রমণ চালালে সেটা ‘শেখ হাসিনার প্রভোকেশন’ বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে তিনি ভারতে বসে নিজ দেশে হামলা সমর্থন করছেন পুনরায় ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য। যেমনটি করেছেন ২০২৫-এ শান্তিতে নোবেলজয়ী ভেনিজুয়েলার মারিয়া কোরিনা মাচাদো।

ভারতের এই ‘টেকনিক্যাল লিমিটেশন’ বিষয়টা কাউন্টার পার্ট বাংলাদেশের হুমকিদাতারাও জানেন, সে কারণে এখানে বসে কিছু অথর্ব রিটায়ার্ড পার্সনরা হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাচ্ছেন। চার ঘন্টায় কলকাতা দখলের হুমকি-ধামকি দিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ফেলছেন। ভারতের নীরবতা এদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরা ভেবে বসে আছেন-ভারত ভয় পেয়েছে! এই ধরণের অপরিপক্ক লোকজনের বায়বীয় হুমকি-ধামকির কারণে পাকিস্তানও এখন তাদের কাঙ্ক্ষিত ‘ইস্টার্ন ফ্রন্ট’ নিয়ে বেশ আশাবাদী। নিজেদের পেছনের কাপড় খুলে গেলেও লজ্জা নাই, অন্যের কাপড় খুলতে পারার মধ্যেই জজবায়ে জোশ।

‘চিকেনস নেক’ অশান্ত প্রজেক্ট ফেল করলে ইউনূসের নেক্সট অপশন জঙ্গি লেলিয়ে সীমান্তের এপার-ওপার দুই পারই অশান্ত করে তোলা। গত ষোল মাসে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে একাধিক রুটে দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকেছে এবং বেরিয়েছে। সঙ্গে আছে ২০২৪-এর লুট হওয়া মারনাস্ত্র। সেসব পড়েছে একাধিক জঙ্গি ক্যাডার ও উপদেষ্টার ‘মিলিশিয়া বাহিনী’র হাতে। যার তাপে উপেদেষ্টা এবং এনসিপির শিশু নেতারা প্রকাশ্যে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। ইউনূসের প্ল্যান; এদের দিয়ে দুই পার অশান্ত করে তোলা, যাতে করে নির্বাচন পিছিয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার আকাঙ্খায় তিনি একটার পর একটা ‘প্রজেক্ট’ ইমপ্লিমেন্ট করবেন। এর ফলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলেও তার কিছু যাবে-আসবে না।

তবে সক্ষমতা, যুদ্ধবাস্তবতা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিশালত্ব, জনগণ সাথে না থাকার কারণে তাদের এইসব প্ল্যান নিশ্চিতভাবেই ভেস্তে যাবে। আইএসআইসহ পাকিস্তানি সেনা কর্তাদের আশ্বাস-প্রশ্রয়-পরামর্শ, তুর্কি মারনাস্ত্র, তুর্কি টাকা, তুর্কি কুমন্ত্রণা, সিআইএ-র প্রত্যক্ষ্য মদদ, ডিপস্টেটের অবারিত ডলার, সমর্থনে বলিয়ান হয়ে হিজবুত তাহরির, লস্কর-এ-তৈয়বা, জইশ-এ-মোহাম্মদ, হিজবুল মুজাহাদিন, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, জেএমজেবি, শাহাদত-ই-আল হিকমা, হিযবুলমুজাহিদিন, আল্লাহর দল, শহীদ হামজা ব্রিগেড, হিযবুত তাওহীদ, আসিফ রেজাকমান্ডো ফোর্স, আনসার আল ইসলামসহ দেশ-বিদেশের জঙ্গিরা স্লিপার সেল তৈরি করবে, ভারতে পুশইন করবে, দুচারটে বোমা বিস্ফোরণ হবে, এপারে মিছিল-সমাবেশ করে শক্তিমত্তা দেখিয়ে যে কোনও সময় গজওয়াতুল হিন্দ বাস্তবায়ন করে ফেলবে বলে হুঙ্কার দেবে।

যদিও এদেরকে দিয়ে ভারতের ‘চিকেনস নেক’, ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর কিছুই করতে পারবে না। দেশকে হয়ত কিছু সময়ের জন্য অশান্ত করতে পারবে, ওই অতটুকুই। পাকিস্তান পেছনে আছে ভেবে এরা লম্ফঝম্ফ দিচ্ছে, সেই পাকিস্তানের সমস্ত শক্তি দিয়েও কিচ্ছু করতে পারবে না। বাগাড়ম্বরই সার হবে। ভারতের কিছু করতে পারুক না পারুক এতে ইউনূস গংয়ের মনবাঞ্ছা পুরণ হতে পারে। এইসব অরাজকতা অজুহাতে নির্বাচন অনির্দিষ্টকাল পিছিয়ে ইন্টেরিম ক্ষমতা দীর্ঘ করতে পারে। সেটাই এদের এজেন্ডা।

Tags :

Monjurul Haque

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025