কানাডা পাঠানোর নামে নেপালে নিয়ে নির্যাতন

সিলেট থেকে নেপাল হয়ে কানাডা পাঠানোর প্রলোভনে পড়ে মানবপাচারকারীদের ফাঁদে জিম্মি হয়েছিলেন তিন তরুণ। বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাঁদের নেপালে নিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট ও মোবাইল কেড়ে নিয়ে অস্ত্রের মুখে আটকে রাখে পাচারকারীরা। পরে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তবে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের উদ্যোগে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান এ তথ্য জানিয়েছেন।

প্রতারণার শিকার তিন যুবক হলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকার হাফিজুর রহমান, মোমিনখলার এম এ মান্না ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলসাইন্দ নাযাত টিল্লার শাহরিয়ার রহমান রনি।

শরিফুল হাসান জানান, সম্প্রতি সিলেটের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তারা খবর পান যে, তাঁর ভাইসহ তিনজনকে কানাডায় পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে নেপালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতি ছিল- কানাডায় পৌঁছানোর পরই খরচ পরিশোধ করতে হবে। সেই অনুযায়ী ১৩ অক্টোবর সিলেট থেকে তিনজন নেপালে যান। নেপালে পৌঁছানোর পর তাঁদের কাঠমান্ডুর একটি হোটেলে রাখে পাচারকারীরা। সেখানে পাসপোর্ট ও মোবাইল কেড়ে নিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদের জিম্মি করে রাখে।

এরপর তাঁদের পাসপোর্টে কানাডার ভিসা ও টিকিট লাগানো ছবি পাঠিয়ে পরিবারকে জানানো হয়, তাঁরা কানাডায় পৌঁছে গেছেন। এমনকি কানাডার একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় দালালকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। পরবর্তীতে প্রত্যেকের কাছে আরও ১২ লাখ টাকা দাবি করে পাচারকারীরা।

এতে পরিবারের সন্দেহ হলে তাঁরা স্থানীয় দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর পাচারকারীরা আরও চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং জিম্মিদের নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়।

শরিফুল জানান, ২৬ অক্টোবর ভুক্তভোগীদের পরিবার ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুরো ঘটনা জানায়। এরপর ব্র্যাক সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি), সিআইডি এবং নেপালের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধার অভিযানের ব্যবস্থা করে। সিলেটের কোতোয়ালি থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা দায়ের হয়। ওই রাতেই পুলিশের যৌথ অভিযানে স্থানীয় একজন দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারের খবর পাচারকারীদের কাছে পৌঁছালে, তাঁরা ওই রাতেই কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের পাশে তিনজনকে ছেড়ে দেয়। পরে ৩০ অক্টোবর তাঁরা ঢাকায় ফেরেন। ব্র্যাকের ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম তাঁদের সহায়তা দেয় এবং পরবর্তীতে গোয়েন্দা সংস্থা তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করে।

ব্র্যাক জানিয়েছে, শুধু কানাডা নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশেও নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নেপালে আটকে রেখে একইভাবে নির্যাতন ও অর্থ আদায়ের ঘটনা ঘটছে। যেহেতু নেপালে ভিসা ছাড়া অন-অ্যারাইভাল ভিসায় যাওয়া যায়, তাই পাচারকারীরা এই দেশকেই প্রথম ধাপ হিসেবে ব্যবহার করছে।

শরিফুল হাসান বলেন, নেপাল হয়ে কানাডা বা ইউরোপ পাঠানোর নামে যারা প্রলোভন দিচ্ছে, তাদের থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ যেন এমন ফাঁদে না পড়ে। কোনো সন্দেহজনক প্রস্তাব এলে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানায়, বিদেশে বিপদে পড়া যে কেউ তাদের সহায়তা চাইতে পারেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্র্যাক মানবপাচার রোধ ও ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসনে কাজ করে যাচ্ছে।

নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন তিন যুবক

কানাডা পাঠানোর নামে প্রতারণার শিকার যুবক এম এ মান্নান জানান, সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায় ভিডিও এডিটিংয়ের ব্যবসা ছিল তার। সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা রিজওয়ানের মাধ্যমে মানবপাচারকারী মিজানুর আমিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । প্রায় তিন বছরের পরিচয়ে অনেক ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

মান্নান বলেন, এত ভালো সম্পর্কের মাঝে যে এভাবে আমাদের বিপদে ফেলবে আমি চিন্তুাও করিনি। মিজানুর আমাদেরকে বলে নেপাল থেকে কানাডার ভিসা করিয়ে দেবে। ১২ লাখ টাকা কানাডা পৌঁছে দেবে। কানাডায় গিয়ে ৫ লাখ টাকা ও বাকি টাকা সেখানে গিয়ে কাজ করে পরিশোধ করার কথা শুনে আমি রাজি হয়ে যাই। নেপাল পৌঁছা পর্যন্ত আমরা তিনজনের কেউ বুঝতে পারিনি যে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি বা জিম্মি হব। কিন্তু যখন হোটেল থেকে আমাদের পাসপোর্ট নেওয়া হলো তখন আমরা বুঝতে পারি কিছু একটা সমস্যা আছে। পরে আমাদের হোটেল থেকে কানাডার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাবার কথা বলে যখন গাড়িতে তুলে একটা নির্জন এলাকার বাড়িতে নিলো তখন আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারি আমরা প্রতারক চক্রের হাতে পড়ে গেছি। কানাডা যাওয়ার জন্য ব্যবসাও হাতছাড়া করেছি। নেপালে জিম্মি থাকা অবস্থায় আমার পরিবার চার লাখ টাকা দিয়েছে দালাল মিজানুরকে।

আরেক যুবক হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদেরকে যখন নেপালে নির্জন এলাকার বাড়িতে নিলো তখন আমাদের সঙ্গের শাহরিয়ার রহমান রনি তার মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করল। লাইভ লোকেশন বাংলাদেশে মিজানুরের কাছে পাঠায়। ওই বাড়িতে নিয়ে তারা আমাদের হাত-পা বেঁধে মোবাইলগুলো কেড়ে নেয়। অনেক মারধর করে। রনি ভিডিও করায় ওকে বেশি মারে। ওর হাত সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা আমাদের বাড়িতে কল দিয়ে বলতে বলে যে আমরা এখন হংকং যাচ্ছি। সেখান থেকে কানাডা যাবো। জিম্মিকারীরা ওই রুমে এয়ারপোর্টের মতো সাউন্ড বাজায়। তারপর আমাদের ছবি, ভিডিও এডিট করে বাংলাদেশে মিজানুরের কাছে পাঠায়। মিজানুর সেগুলো আমাদের পরিবারকে দেখায়। তারা বিমানের টাইম মেন্টেইন করে করে আমাদের দিয়ে কল করিয়েছে। সবশেষ আমাদের বন্দুকের মুখে রেখে পরিবারের সঙ্গে কথা বলায়। তখন আমরা বলতে বাধ্য হই যে আমরা কানাডা পৌঁছে গেছি, তোমরা মিজানুরকে টাকা দিয়ে দাও। তখন আমার পরিবার মিজানুরকে ৫ লাখ টাকা দেয়। ধার-কর্জ করে আমার বোনের স্বর্ণ বিক্রি করে এই টাকা দেওয়া হয়। আমরা যখন কল দিয়ে বলি কানাডা পৌঁছে গেছি তখন শাহরিয়ার রহমান রনির পরিবার বুঝে যায় কোনো সমস্যা আছে।’

প্রতারিত যুবক শাহরিয়ার রহমান রনি বলেন, তারা আমাকে অনেক বেশি মারধর করে। এতে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তারা ইনহেলার এনে দেয়। এরপর কিছুটা সুস্থ হলে আমার পরিবারের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে বলে। তখন ভিডিওকলে আমি কানাডা পৌঁছে গেছি বললেও আমার পরিবারের সন্দেহ হয়। তারা তখন দালাল মিজানুরের বাসায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে। সে তখনও কিছু স্বীকার করেনি। বলে ফেরত আনার জন্য ৫ লাখ টাকা লাগবে। আমার পরিবার তাকে টাকা দেয়। পরে আমার বাবা থানায় মামলা করলে পুলিশ মিজানুরকে আটক করে। তখন যারা আমাদের নেপালে জিম্মি করে তারা ফোনে জানতে পারে মিজানুরকে পুলিশ আটক করেছে। এটা জেনে তারা আমাদের নেপাল এয়ারপোর্টের পাশে ফেলে যায়। এরপর আমরা এয়ারপোর্টের ঢুকে ওয়াইফাই কানেক্ট করে বাড়িতে কল দিয়ে জানালে নেপালের একজন পরিচিত আমাদেরে নিয়ে যান ও পরে দেশে পাঠান। দেশে আসার পর ব্র্যাকের পক্ষ থেকে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করা হয়।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025