দেশে সংসদ নেই। চলছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কঠিন। এবার এমন কঠিন পরিস্থিতিতেই বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর প্রথম বাজেট কেমন হতে যাচ্ছে, এই প্রশ্নের মধ্যে সরকার বেশ কিছু খাতে কর কমানোর পাশাপাশি বেশ কিছু খাতে বৃদ্ধির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে না পারার মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সরকারের জন্য সুখকর নয়।
তবে জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের জন্য সরকারের আয় ব্যয়ের কর্মপরিকল্পনা বা বাজেট দিতেই হবে। সংসদ না থাকায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের মতো রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতে ভাষণ দিয়ে এটি উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা। আগামী সোমবার এই বাজেট বক্তৃতা বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট উপস্থাপন করবেন, তার একটি খসড়া দেশকাল নিউজ ডটকমের হাতে এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা সেই খসড়ার সত্যতা নিশ্চিতও করেছেন।
এটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, জনগণকে সরাসরি প্রভাবিত করে, এমন বেশ কিছু খাতে কর বাড়াতে যাচ্ছেন উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। আবার কিছু খাতে কর কমিয়ে করজাল বাড়ানোর পরিকল্পনাও আছে তার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, “কর জিডিপির অনুপাত বাড়াতে কর কাঠামো ও নীতিমালাকে আরও কার্যকর এবং প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য প্রয়োজন কর যৌক্তিকীকরণ। সেই চেষ্টাই হবে এবার।”
“এতে রাষ্ট্র পরিচালনায় অতি প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায়ে যেমন গতিশীলতা আসবে তেমনি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকবে অবারিত”- বলেন তিনি।
কর কমবে কোথায় কোথায়
প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ও সরবরাহকারীদের স্বস্তি প্রদানের লক্ষ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন ধান, চাল, গম, আলু, পাট, কাঁচা চা পাতা ইত্যাদি সরবরাহের ক্ষেত্রে সরবরাহ মূল্যের ওপর উৎসে কর কর্তনের হার ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করা হচ্ছে এবার। ইন্টারনেট সেবা থেকে উৎসে কর কর্তনের হার ১০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ করতে যাচ্ছেন উপদেষ্টা।
জমি হস্তান্তর থেকে কর সংগ্রহের বিদ্যমান মূলধনি মুনাফা কর হার এলাকাভেদে ৮, ৬ ও ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৬, ৪ শতাংশ ও ৩ শতাংশ করা হবে। এতে জমির প্রকৃত বিক্রয়মূল্যে সম্পত্তি নিবন্ধন হবে বলে আশা করছে সরকার। ফলে কালো টাকা তৈরি হবে না।
পরিবেশবান্ধব রিসাইক্লিং শিল্পকে উৎসাহ দিতে এই শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর হার ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ শতাংশ করা হচ্ছে। সম্ভাব্য মুনাফার পরিমাণ বিবেচনায় ঠিকাদারি কাজ হতে উৎসে কর কর্তনের সর্বোচ্চ হার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তনের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ করা হচ্ছে। তেল পরিশোধন কোম্পানির তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ক্রয়ের অর্থ পরিশোধকালে উৎসে কর হার ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হচ্ছে।
মোবাইল অপারেটরদের টার্নওভার করের পরিমাণ ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। মোবাইল অপারেটর, তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী এবং কার্বোনেটেড বেভারেজ ব্যতীত অন্যান্য সকল ব্যবসায়ী করদাতাদের টার্নওভার করের হার ১ শতাংশ করা হয়েছে।
স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে টার্নওভার করের আওতামুক্ত সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা।
কর বাড়ছে যেসব খাতে
সম্ভাব্য মুনাফার পরিমাণ বিবেচনায় ১৫২টি পণ্যের ওপর আমদানি পর্যায়ে হ্রাসকৃত ২ শতাংশ হারে অগ্রিম কর আরোপ করতে যাচ্ছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সিকিউরিটিজ এর সুদ হতে উৎসে কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। ভাড়া পরিশোধকালে উৎসে কর হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। সিগারেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নিট বিক্রয়মূল্যের ওপর অগ্রিম করহার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্ভাব্য মুনাফার পরিমাণ বিবেচনায় বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত মোটরযান হতে অগ্রিম কর সংগ্রহের হার যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করার কথাও বলছে সরকার।
ব্যবসায়ী করদাতার ক্ষেত্রে নগদ লেনদেন ক্রমান্বয়ে নিরুৎসাহিত ও কর আদায় সহজ করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন সংক্রান্ত পূর্বের বিধান শিথিল করতে আপত্তি নেই অর্থ উপদেষ্টার।
বেতন, ভাড়া ও কাঁচামাল বাবদ প্রদর্শিত ব্যয় ব্যতীত অন্যান্য সব ব্যয়ের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে থাকলে তার ২৫ শতাংশ অননুমোদনযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করার বিধান রাখতে যাচ্ছেন।