লালমনিরহাটের পরেশ চন্দ্র শীল এবং তাঁর পুত্র বিষ্ণু চন্দ্র শীল পেশায় নাপিত। নাপিতের দোকানে গেলে মানুষ নানারকম গপসপ করে।
পরেশ চন্দ্র বা ওঁর পুত্র নাকি এইরকম গপসপ করার সময় প্রফেটের নাম নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর নামের শেষে যে দরুদ বা দোয়াটা পড়তে হয় সেটা পড়েননি। ব্যাস, পরেশের দোকানে ও দোকানের আশেপাশে থাকা কিছুসংখ্যক মুসলিম ওদের ইচ্ছেমতো মারধর করেছে। মারধর করে পিতা-পুত্র দুইজনকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করেছে। ঐসব মুসলমানের নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। যতটুকু জেনেছি, পরেশ ও বিষ্ণু এখনো কারাগারে আছে। থাকুক কারাগারে। পরেশ আর পরেশের ব্যাটা, ওরা গরিব মানুষ। গরিব মানুষের জন্য জেলে থাকা আর জেলের বাইরে থাকার মধ্যে কিই বা পার্থক্য আছে!
আমি ভিডিওটা দেখেছি। আপনিও নিশ্চয়ই দেখেছেন। না দেখে থাকলে দেখে নেন।
পরেশকে দাঁড়িওয়ালা একজন লোক ধরে রেখেছে আর অন্যরা ওকে কিল-ঘুষি-লাথি মারছে। ওঁর পুত্র বিষ্ণু, হাতজোর করে সকলের কাছে মাফ চাইছে, মানুষের হাতে-পায়ে ধরছে। কিন্তু ঐ লোকগুলো উম্মত্ত- লেনিন যেটাকে বলেছেন spiritual booze, সেই মাদকে মত্ত। ওরা পরেশ ও বিষ্ণুর কান্নায় মোটেই বিচলিত নয়। ওরা বাপ-ব্যাটাকে পেটাতে থাকে নির্দয়ভাবে। বাপ-ব্যাটা কাঁদছে। আমি একবার পরেশের কথা ভাবি, একবার বিষ্ণুর কথা ভাবি। যত বড় অপরাধই করুন, আপনার সামনে আপনার পিতাকে পেটাচ্ছে বা আপনার সামনে আপনার যুবক পুত্রের সামনে আপনাকে পেটাচ্ছে- এই অপমান, এই গ্লানি আপনার কেমন লাগবে!
আমার কোনো ক্রোধ হয় না। আমি কোনো প্রতিবাদ করার জন্য এই পোস্ট লিখছি না। আমার কান্না পায়। কান্না পায়, কেননা এই পরেশকে আমি চিনতে পারি। আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, আমি দেখেছি আমার সমবয়সী বন্ধুরা স্কুলে আসতে পারছে না বা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে কেবল ওদের পিতা-মাতার আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে। শৈশবে আমি ভাবতাম, দেশে সমাজতন্ত্র আনবো। সমাজতন্ত্রের জন্যে আমার আকাঙ্ক্ষার কারণ সমাজতন্ত্র হলে দেশের প্রতিটা শিশু স্কুলে যাবে, প্রতিটা শিশুর সমান অধিকার থাকবে শিক্ষালাভের। পরেশকে আমি চিনতে পারি, কারণ পরেশ হচ্ছে আমার সেইসব বন্ধুদের একজন যে কিনা ছোটবেলায় স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
না, আমি সেই লড়াইটা জিততে পারিনি। দেশে সমাজতন্ত্র হয়নি। সমাজতন্ত্র হয়নি বলে পরেশের পুত্রও খুব একটা লেখাপড়া করতে পারেনি। কি করে করবে! পরেশরা তো কেবল দরিদ্র নয়, সে হচ্ছে আবার হিন্দু। শুধু হিন্দুও না, হিন্দুর মধ্যে আবার ওরা হচ্ছে শীল- জাতে নিচু। পরেশের পুত্র বিষ্ণু সমাজে বিদ্যমান সকল বৈষম্যের আদর্শ শিকার। ওর জন্য এটাই ছিল ভবিতব্য- শীলের ব্যাটা, নাপিতের ছেলে নাপিতই হবে। আমি সারাটা ছাত্রজীবন চিৎকার করেছি ‘শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার’। শ্লোগানই দিয়ে গেছি, সেটাকে আর বাস্তবায়ন করতে পারিনি। না, লড়াই ছাড়িনি, কিন্তু বিষ্ণুর জন্যে তো শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি।
যারা এই পোস্ট পড়ছেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ করি- মেহেরবানি করে দৃশ্যটা দেখুন। বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা নির্যাতন সবকিছুরই কি রিয়ালিস্টিক ডেপিকশন হয়েছে ঐ কয়েক মিনিটের রিয়্যাল লাইফ ভিডিওতে। আপনি মোটা মোটা বইতে যেসব ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান পড়েছেন, সেইগুলি যদি আপনাকে এই দৃশ্যের প্রকৃত মাজেজা দেখতে সাহায্য না করে, তাইলে ছুঁড়ে ফেলুন সেইসব বই। নতুন করে পড়ুন। জীবন আমাদের জন্য শিক্ষার উপকরণ খুলে রাখে জীবনের প্রতিটি স্তরে। আপনার দেখার চোখ নাই। আপনি সমাজকে দেখার সেই চোখটা তৈরি করুন। পরেশ আর বিষ্ণুর আজ যে দুর্গতি- সেটা ঠিকমতো দেখুন, দেখতে শিখুন।
তরুণ বন্ধুরা, জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। আর এই সম্পদ আমরা পাই কেবল একবার। আমরা ছাত্রজীবনে ‘ইস্পাত’ থেকে এই উদ্ধৃতি খুব পড়তাম। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই জীবন আপনি কিভাবে ব্যয় করবেন। যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসা এই পচাগলা সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার লড়াইয়ে কি আপনি অংশ নেবেন না? আপনি কি বলবেন না যে পরেশ আর বিষ্ণু এই দেশের যে কোনোনাগরিকের মতোই দুইজন নাগরিক, কারো চেয়ে ছোট নয়। আপনি কি বলবেন না যে জাত-পাত, ধর্ম বিশ্বাস এসবের কারণে পরেশ আর বিষ্ণুর সাথে অন্যায় করা হয়েছে? আপনি কি বলবেন না মানুষের অধিকারের কথা?
বিদ্রোহ করবেন না? লড়বেন না পরেশ ও বিষ্ণুদের জন্য?