সিলেটের তোপখানা এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) পাঁচ তলা ভবনটি বর্তমানে পরিবহন শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে সিসিকের শিক্ষা ও লাইব্রেরি শাখা। গত চার মাস ধরে এই শিক্ষা ও লাইব্রেরি শাখা দখল করে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট জেলা ও মহানগরের দায়িত্বশীলরা।
ওই ভবনে কর্মরত সিসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে সবাইকে জিম্মি করে পাঠাগারে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। এমনকি প্রধান লাইব্রেরিয়ান শাহিদা সুলতানার কক্ষ (৩০২ নম্বর কক্ষ) নিজেদের দখলে নিয়ে তালা দিয়ে রেখেছেন তারা। পাঠাগারে এসে ৩০২ নম্বর রুমে, লাইব্রেরিতে যেখানে মানুষজন বসে লেখাপড়া করেন সেখানে ও লাইব্রেরির হলরুমে প্রবেশ করে সভা করেন তারা। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত চলের তাদের সভা।
সিসিক সূত্রে জানা যায়, ওই পুরনো পাঁচ তলা ভবনে এখনো সিসিকের পরিবহন শাখা ও শিক্ষা শাখার কার্যক্রম চলে। ভবনের তৃতীয় তলায় আছে সিসিক পরিচালিত একমাত্র পাঠাগার। ‘পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার’ নামক এই পাঠাগারে রয়েছে সব ধরনের পত্রিকা ও ম্যাগাজিন। রয়েছে ১০ হাজারে অধিক বই। ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত যে কেউ বিনামূল্যে এসব পত্রিকা ও বই পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
সিসিকের পরিবহন ও শিক্ষা শাখায় কর্মরতরা জানান, চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই ভবনের তৃতীয় তলার শিক্ষা ও লাইব্রেরি শাখায় দখল করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেটের নেতৃবৃন্দ। তারা এসে এখানে দায়িত্বরতদের বলেন, প্রধান লাইব্রেরিয়ান শাহিদা সুলতানার ৩০২ নম্বর কক্ষ তাদেরকে দেওয়ার জন্য। এরপর থেকে প্রধান লাইব্রেরিয়ান ওই রুম ছেড়ে দিয়ে সহকারী লাইব্রেরিয়ানের সাথে বসে করেন। এরপর পাঠাগারের হলরুমে ও শিক্ষা শাখার সকল অফিসের রাখা সব চেয়ার তার জোরপূর্বক ৩০২ নম্বর রুমে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করেন। ওই চেয়ারগুলো তারা ৩০২ নম্বর রুমে রেখেই তালা দিয়ে চলে যান। এমনকি তারা অন্য কক্ষের বাথরুম পরিষ্কার করার সামগ্রীও কাউকে না বলে নিয়ে যান। কখনো অফিস টাইমে আবার কখনো অফিস টাইমের বাইরে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সভা চলে এখানে।
সম্প্রতি সিসিকের তোপখানা এলাকাস্থ ভবনের শিক্ষা ও লাইব্রেরি শাখায় ঘুরে দেখা যায়, লাইব্রেরিতে বসে লেখাপড়া করছেন কয়েকজন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিএসসি শেষ করে এখন চাকরির প্রস্তুতি নিতে সিসিকের এই লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসা দুজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয়। তারা বলেন, এই লাইব্রেরি সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ জানেন না। তাই এখনে অধ্যয়ন করতে শিক্ষার্থীরা কম আসে। শিক্ষার্থী পরিমাণ কম থাকলে মনোযোগ দিয়ে পড়া যায়। তাই আমরা এখানে নিয়মিত আমি। কিন্তু অনেকদিন ধরে এখানে নিরিবিলি বসে পড়া যায় না, কারণ অনেক মানুষজন এসে এখানে আড্ডা দেন বা সভা করেন। শুনেছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিস এখানে। তাই বিভিন্ন সময় তারা মিটিং করেন। হৈ-হুল্লোড় করেন। তারা এলেই আমরা বেরিয়ে যাই।
শিক্ষা ও লাইব্রেরি শাখায় কর্মরতরা জানান, এখানে ৫ জন নারী স্টাফ কাজ করেন। প্রায় প্রতিদিনই এখানে ৩০ থেকে ৫০ জন ছেলে আসে। কিছুদিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেত্রী ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেন তাদেরই আরেক নেতার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনাও এই ৩০২ নম্বর কক্ষে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এখানে কর্মরত নারী স্টাফরা নিরাপত্তার শঙ্কায় থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবহন ও শিক্ষা শাখায় কর্মরত কয়েকজন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা দুইভাগে বিভক্ত এখন। একপক্ষ ৩০২ নম্বর রুমে কাজ শেষ করে তালা দিয়ে চাবি নিয়ে যায়। আরেকপক্ষ এসে রুম বন্ধ পেয়ে লাইব্রেরিতে ও হলরুমে বসে সভা করে। তারা যে পরিমাণ মানুষ আসে, সে পরিমাণ চেয়ারও নেই আমাদের অফিসে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে চেয়ার ভাড়া করেও আনে তারা। অনেক সময় আমরা চেয়ারে বসে কাজ করার সময় তারা আমাদের কাছ থেকে চেয়ার নিয়ে যায়। তখন সকল কাজ আমরা দাঁড়িয়ে করে থাকি। তাদের রুম পরিষ্কার করে দিতে হয়। তাদেরকে চা, পানিও এনে দিতে হয়। মোট কথা, তারা এলে আমাদের অফিসের সব কাজ বন্ধ করে তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়। আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতনদের কিছু বললেও কাজ হয় না। সবাই তাদের ভয় পায়। আমাদের ঊর্ধ্বতনরা শুধু বলেন এসব নিয়ে কথা না বলতে।
তারা আরও বলেন, এই ভবনে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। সিসিকের দুটি শাখার অনেক নথিপত্র আছে এই ভবনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের এখানে রাত-বিরাতে অবাধ বিচরণ থাকে। এখানে কোনো অঘটন ঘটলে বা কোনো নথিপত্র গায়েব হলে এর দায় কে নেবে?
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট জেলার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম বলেন, এটা আমাদের অফিস না। এখানে তিনতলায় লাইব্রেরি আছে। সেখানে গিয়ে আমরা মাঝেমধ্যে বই পড়ি, বসি, কথা বলি। এখানে অনেক চেয়ার আছে, বসার জায়গা আছে।
লাইব্রেরিকে কীভাবে অফিস হিসেবে ব্যবহার করছেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অফিস হিসেবে আমরা ব্যবহার করছি না। লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করছি।
লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করলে অফিস টাইমের পরে গভীর রাত পর্যন্ত আপনারা কীভাবে সভা করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাত পর্যন্ত আমরা মাঝে-মধ্যে বসা হয়। একটা রুমের চাবি আছে আমাদের কাছে। তাই আমরা যেকোনো সময় গিয়ে পড়তে পারি।
চাবি কীভাবে নিয়েছেন সিসিকের কাছ থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের মুখ্য সংগঠক গালিব ভাই (আসাদুল্লাহ আল গালিব) সিটি করপোরেশনে কথা বলে চাবি এনেছিলেন। এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলেন।
এ ব্যাপারে গালিবের মোবাইলে কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
বৈছাআ সূত্রে জানা গেছে, এসব কারণে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটির একাংশ গালিবকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এরপর থেকে তিনি গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কোনো রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়নি সিলেট সিটি করপোরেশন থেকে। আমি যতদূর জানি তারা লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে। পড়াশোনা করার জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না। কারণ লাইব্রেরি ওপেন থাকে।
গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করার কোনো নিয়ম আছে কি না এবং সিসিক বরাদ্দ না দিলে তারা কি জোরপূর্বক রুম ও আসবাবপত্র ব্যবহার করতে পারেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা জানতাম তারা এখানে বসে পড়াশোনা করে। যেহেতু আপনি বলছেন তারা এসব করছে, আমরা খোঁজ নেব। পড়াশোনা করতে বলে তারা যদি এটার মিসইউজ করে, তাহলে সেটা আমরা মেনে নেব না।