তারিখ ইব্রাহিম নামে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ লিখতেন তিনি। আমরা তখন অপেক্ষা করে থাকতাম, আজ যায় যায় দিন বের হবে, তারিখ ইব্রাহিমের বিশ্লেষণ পড়বো। আমি আপনাদেরকে একরকম নিশ্চিত বলতে পারি, আমাদের জীবদ্দশায় আমি বাংলায় ঐরকম চমৎকার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আর পড়িনি। সংবাদে দরবার-এ-জহুর কলামটা লিখতেন জহুর আহমেদ চৌধুরী আর অনিকেত নামে আরেকটা নিয়মিত কলাম লিখতেন নির্মল সেন। ওঁরা তো মুরুব্বি মানুষ, অনেক বড় সাংবাদিক, লিখতেনও চমৎকার- ওদের প্রতি সম্মান রেখেই কথাটা বলছি।
সংবাদেই ‘সময় বহিয়া যায়’ লিখতেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গাছপাথর নামে। সেটা একটু ভিন্ন মেজাজের ছিল, সেটা আমি অন্যদের কাতারে ফেলতে চাই না। একইভাবে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখাও আমি অন্যদের সাথে তুলনার ঝামেলায় যাবো না। এছাড়া অন্য কেউ হয়তো থাকতেও পারেন যাদের লেখা আমি পড়িনি বা ঠিক এই সময় মনে পড়ছে না। এছাড়া অন্য সকলের লেখার চেয়ে আমি তারিখ ইব্রাহিমেক এগিয়ে রাখবো। তারিখ ইব্রাহিম ছদ্মনামে সেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণগুলি লিখতে বিভুরঞ্জন সরকার।
বিভুদা আমার ছাত্র ইউনিয়ন করা বড়ভাই বলে তাঁকে পছন্দ করি সেজন্য এরকম কথা বলছি? না, জনাব। বরং বলতে পারেন তারিখ ইব্রাহিম নামের পেছনে মানুষটা তিনিই ছিলেন জেনে উল্টো তাঁর প্রতি আমার ভক্তি-ভালোবাসা বেড়ে গিয়েছিল।
যে পরিস্থিতিতে বিভুদার মৃত্যু হলো সেটাকে তো আমি কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা বলতে পারছি না। এটা একটা হত্যাকাণ্ড। আমি জানি বিভুদার দেহ ওরা কাটাছেঁড়া করবে, একটা ময়নাতদন্ত হবে- এগুলো ঠিকঠাক মতো হবে কি না জানি না। যদি ঠিকঠাক মতো হয়ও, সেটা তো নিতান্ত শারীরিক ময়নাতদন্ত হবে আর কি। কিন্তু একজন মানুষকে তো শারীরিকভাবে হত্যা করা ছাড়াও হত্যা করা যায়। সেটার জন্য যে সমাজবৈজ্ঞানিক ময়নাতদন্ত প্রয়োজন সেই ময়নাতদন্ত তো আপনারা কোনোদিনই করবেন না। সেই তদন্তটা যদি কোনোদিন করতে পারতেন তাহলে বুঝতেন, একজন বিভুরঞ্জন সরকার কেন নিহত হয়েছেন বা কিভাবে নিহত হয়েছেন।
সাংবাদিক বন্ধুদের বলি- কেবল সাংবাদিক বন্ধুরাই নয়, দেশের সকল মানুষকেই বলি- কেবল বিভুরঞ্জন সরকারই তো নয়, বাংলাদেশের অসংখ্য সাংবাদিক শারীরিকভাবে নিহত বা আহত না হলেও গুরুতর আহত বা নিহত হওয়ার মতো অবস্থায় বাস করছেন এই দেশে এই মুহূর্তে। কেউ কারাগারে, কেউ একটু ভাগ্যবান এখনও জেলে যাননি। ওদের ওপর এসব হয়রানি হচ্ছে শুদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে ওদের মতামত প্রকাশের কারণেই। কোনো কোনো সিনিয়র সাংবাদিক আছেন, যারা প্রতিদিনের সংসার খরচ চালানোর মতো অর্থ যোগাড় করতেও হিমশিম খাচ্ছেন। আপনারা কি দাঁড়াবেন না আপনাদের বিপন্ন বন্ধুদের পাশে ওদের অধিকার রক্ষায়?
বিভুদার এরকম মৃত্যুতে আমি শোকাহত তো বটেই, সেই সাথে আমি শঙ্কিতও বটে। আসলেই শঙ্কিত, গুরুতর শঙ্কায় শঙ্কিত। শঙ্কিত সেইসব সাংবাদিকদের জন্য যারা এখনও বেঁচে তো আছেন বটে, কিন্তু বেঁচে আছেন প্রবল আতঙ্ক নিয়ে।