বিপদে কেউ নেই ইরানের পাশে!

বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ইরান। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, পরিস্থিতি যদি ইরানি শাসকরা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারেন, তাহলে বিপ্লবী সরকারের পতনও হতে পারে। এমন ঘোরতর বিপদের দিনে ইরানের মিত্ররা কেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না, এই প্রশ্নই এখন অনেকের মনে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আজীবনের মিত্র বলে যে কিছু নেই- ইরানের এই সংকট মুহূর্তে দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার চুপ থাকাই তা স্পষ্ট করে। এখন পর্যন্ত রাশিয়া যেই প্রতিক্রিয়া দিয়েছে- তা পুরোপুরি দায়সারা।

একই অবস্থা চীনেরও। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে চীন সেই অর্থে মিত্রদের জন্য বড় কোনো অবদান রেখেছে- এমন কোনো নজির নেই। বেইজিংয়ের লক্ষ্য থাকে কেবল ব্যবসা।

রাশিয়া হাত গুটিয়ে কেন?

রাশিয়া টুডেতে প্রকাশিত রুশ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভিটালি রিউমশিনের লেখা এক নিবন্ধে এর কিছু কারণের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত যত দীর্ঘ হবে- অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম তত বাড়বে, যা রাশিয়াকে আর্থিকভাবে লাভবান করবে।

এ ছাড়াও রিউমশিনের মতে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে হওয়া একটি বড় যুদ্ধ ওয়াশিংটনকে ইউক্রেনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে পারে। এর কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা গেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, ইউক্রেন ও আশেপাশের দেশ থেকে বড় সংখ্যায় সমরাস্ত্র এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাস্তবতা হলো- শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়। ইউরোপের ইসরায়েলপন্থী দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্ব দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেন হয়ে উঠবে রাশিয়ার কাছে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো।

রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনে হামলা ব্যাপক জোরদার করেছে। ফলে একই সঙ্গে রাশিয়ার পক্ষে ইরানকে সহায়তা করা সম্ভব নয়। দুই দেশের মধ্যে এমন কোনো চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতাও নেই। কেবল একটি সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, যার আলোকে দুই দেশ তাদের শত্রু দেশকে সহায়তা করতে পারবে না।

তবে একটি দিক বিবেচনায় হয়ত সামনের দিনগুলোতে ইরানকে সহায়তার চেষ্টাও করতে পারে রাশিয়া। কারণ, ইরানের যুদ্ধে টিকে থাকা মস্কোর স্বার্থের জন্য ইতিবাচক।

ভিটালি রিউমশনের মতে, তাই আপাতত রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হতে পারে কূটনৈতিক ও মৌখিক সমর্থন দিয়ে ইরানের পাশে থাকা।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র যখন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ইরানে হামলার ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেসময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটি সতর্কবর্তা এসেছে।

রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সকে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ পুরো পরিস্থিতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।”

তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল ও ইরানের চলমান সংঘাত নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে।

ইরানের জন্য কতটুকু ভরসা পাকিস্তান?

প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কটা অম্ল-মধুর। সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগের তীর দুই দেশই কয়েকবছর ধরে ছুঁড়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সংঘাতে তেহরানের ইসলামাবাদের প্রতি সমর্থন পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে দেয়।

ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পার্লামেন্টে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, “সব উপায়ে ইরানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে পাকিস্তান।”

কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়, ইসলামাবাদের এক সিদ্ধান্তে। যার সঙ্গে পার্লামেন্টে দেওয়া প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের কোনো মিল নেই। পাকিস্তান উলটো ইরানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বুধবার সাক্ষাৎ করেন দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তার পক্ষে ট্রাম্পের কোনো অনুরোধ প্রত্যাখান করার সুযোগ কম।

বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়, মধ্যপ্রাচ্যের আসন্ন এই যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা কী হবে, তা সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরই নেবেন। যা ইরানের অনুকূলে নাও যেতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যে ‘দুর্বল’ ইরানের মিত্ররা

একেবারে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়- গত ৪৫ বছরে আরব বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে ইরানের তা নেই। কাতার ও ওমানকে ইরানের মিত্র মনে হলেও তা আসলে সত্যি নয়। দেশ দুইটির সঙ্গে ইরানের ভালো কূটনৈতিক যোগাযোগ থাকলেও সেটিকে কৌশলগত মিত্রতা বলার সুযোগ নেই।

কাতার বা ওমান ইরানের পক্ষে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। উলটো কাতারে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি থেকে ইরানে হামলাও হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলতে কয়েকটি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের কারোই অবস্থা ইসরায়েলকে প্রতিহত করার মতো নয়।

ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে লেবাননের শিয়া সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ তাদের নেতা হাসান নসরুল্লাহ সহ সব শীর্ঘ নেতাকে হারিয়েছে। এমনকি ইরানে সরাসরি হামলার পরেও তাদেরকে ইসরায়েলের দিকে কোনো রকেট ছুড়তে দেখা যায়নি।

উল্টো এক বিবৃতিতে ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানালেও সংগঠনটি জানিয়ে দিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে জড়ানোর ইচ্ছে তাদের নেই। একই অবস্থা ইরানের আরেক মিত্র ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হুতি। তাদের ভান্ডারের ক্ষেপণাস্ত্রও ফুরিয়ে এসেছে। খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই।

কঠিন বাস্তবতায় ইরান, ভরসা কেবল ‘ক্ষেপণাস্ত্র’

সবমিলিয়ে ইরান এই সংঘাতে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা যেমন এগিয়ে এসেছে, ইসরায়েলকে রক্ষায় জর্ডান, সৌদি আরবের মতো আরব দেশগুলোও পদক্ষেপ নিয়েছে।

এমনকি ইসরায়েলের কট্টর সমালোচক দেশ তুরস্কের আকাশসীমা ব্যবহার করেও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমান ইরানের সামরিক স্থাপনার তথ্য সংগ্রহ করছে।

এ ছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান যতই ইসরায়েল বিরোধী কথা বলুক- ন্যাটো সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেশটির জন্য কম।

বুধবারও যুক্তরাজ্যের আকাশে তিনটি এফ-৩৫ স্কোয়াড্রনকে দক্ষিণ দিকে যেতে দেখা গেছে, যেগুলো যুক্তরাজ্যের রয়েল এয়ারফোর্সের (আরএএফ) মিল্ডেনহল ও স্পেনের মোরোন ঘাঁটি থেকে ট্যাঙ্কার বিমানের সহায়তায় উড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলোর গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য।

এ ছাড়া এফ-১৬ বিমানের একটি বহর ইতালির অ্যাভিয়ানো এয়ার বেস থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এসব বিমান আগে থেকেই ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি মিলিশিয়ার ড্রোন ভূপাতিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছিল, যেখানে তারা অ্যাডভান্সড প্রেসিশন কিল ওয়েপন সিস্টেম টু (এপিকেডব্লিউএস টু) রকেট ব্যবহার করেছে।

এপিডব্লিউএস টু সংযুক্ত এফ-১৫ই স্ট্রাইক ঈগল যুদ্ধবিমানগুলোও গত বছর ইসরায়েলে ইরানের হামলার সময় আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপও পাঠানো হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে ইউএসএস নিমিৎজ। এটি পূর্ব এশিয়া থেকে যাত্রা করে ইরান ঘেঁষা জলসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

এরই মধ্যে সেখানে রয়েছে ইউএসএস কার্ল ভিনসন। এই যুদ্ধজাহাজগুলো ইসরায়েলের দিকে ছোড়া ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সহায়তা করছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী থেকে পাঠানো প্যাট্রিয়ট এবং থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোও ইসরায়েলের সুরক্ষায় কাজ করছে।

এই বিপুলসংখ্যক ট্যাঙ্কার ও যুদ্ধবিমান মোতায়েন ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ড্রোন প্রতিরোধেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না, বরং প্রয়োজন হলে ইরানের ভেতরেও টার্গেট আঘাত হানার ক্ষমতা রাখতে চায়।

এমনকি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র হয়ত বি-টু স্টেলথ বোমার ব্যবহার করে ইসরায়েলকে ইরানের ভূগর্ভস্থ ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার জন্য সহায়তা করতে পারে।

ইসরায়েলের বিপরীতে ইরান সম্পূর্ণ একা। সংঘাতের ফলাফল যাই হোক- সংঘাত যতদিনেরই হোক, সম্ভবত ইরানকে একাই তা মোকাবিলা করতে হবে।

সেক্ষেত্রে ইরানের ভরসা কেবল তার ক্ষেপণাস্ত্র বহর। ধারণা করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ রয়েছে দেশটিতে।

আর ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের জন্য মোকাবিলাও এত সহজ হবে না। কারণ, দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ‘অ্যারো সিস্টেম’-এর ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে রয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ।

এই সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসলেও দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের পরিচালক টম কারাকো সতর্ক করে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই সারাদিন বসে থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করে যেতে পারবে না। ইসরায়েল ও তার মিত্রদের এখন খুব দ্রুত ও সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে… আমরা কেবল বসে থেকে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সময় নষ্ট করতে পারি না।”

Tags :

International News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025, Jun 19