বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডে হাজার কোটি টাকা ক্ষতির শঙ্কা

রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোটি কোটি টাকার গার্মেন্টস পণ্য, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল এবং আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের শিপমেন্ট পুড়ে গেছে। এ ঘটনায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন অসংখ্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। তাঁদের আশঙ্কা, ভয়াবহ এই আগুনে ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে হাজার কোটি টাকা।

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগুনে শুধু তাদের আর্থিক ক্ষতিই হয়নি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অর্ডারেরও (ক্রয়াদেশ) ক্ষতি হবে। এতে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পর্যন্ত প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ এই কাঁচামাল দিয়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জীবন রক্ষাকারী ও ক্যানসারের ওষুধ তৈরি হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এম আর লজিস্টিকসের কর্মচারী মো. এনায়েত হোসেন বলেন, শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কার্গো ভিলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি, ৮ নম্বর ফটকে আটকে দেওয়া হয়। তাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না বলে জানানো হয়। ফলে প্রায় ২০-২৫ মিনিট সময় নষ্ট হয়। এর মধ্যেই আগুন সারা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

কার্গো ভিলেজের কিউইপি-এক্সপ্রেস নামে একটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী মো. সাইদ হোসেন বলেন, দুপুর সোয়া ২টায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুন দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিস আসে। কিন্তু তারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি।

তবে গতকাল শনিবার রাতে এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা গেটে যে গাড়ি দেখেছেন সেটি হয়তো অন্য কোনো সংস্থার ছিল। আমাদের ফায়ারের ইউনিট যখন ঘটনাস্থালে পৌঁছায় তখন আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।’

রবিবার দেখা যায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ভবনজুড়ে এখনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছে। ধ্বংসস্তূপ দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা।

উত্তরার গার্মেন্টস ইনপুট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফার্স্ট অ্যান্ড সেফ’-এর মালিক মো. বেনজির বলেন, ‘হংকং ও চায়না থেকে দু’টি শিপমেন্ট এসেছিল রেডিমেড গার্মেন্টসের। স্যাম্পল প্রোডাক্টসহ সবই পুড়ে গেছে। আমরা ছোট ব্যবসায়ী—লাখ পাঁচেক টাকার মাল পুড়লেও সেটা আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি। আজ মালামাল খালাসের কথা ছিল, কিন্তু আগুনে সব শেষ!’

শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় আমদানি কার্গো ভিলেজ থেকে মালামাল খালাস বন্ধ ছিল। ভেতরে প্রচুর রাসায়নিক, গার্মেন্টস পণ্য ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল ছিল—সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

মো. বেনজির আরও জানান, এখানে ৬৮টি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস অফিস রয়েছে। তবে ২০-২২টি নিয়মিত কার্যক্রম চালায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার কোটি টাকার মালামাল আসত। এখন প্রায় সবই পুড়ে গেছে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান এমএস জি এস কোম্পানি জানায়, তাঁদের প্রায় ১ লাখ মার্কিন ডলারের কাঁচামাল আগুনে পুড়ে গেছে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘আমরা দেশের নামিদামি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর জন্য চীন, ভারত ও জার্মানি থেকে কাঁচামাল আনি। ভেতরে আমাদের ২০টি শিপমেন্ট ছিল, সবই পুড়ে গেছে। এসব কাঁচামাল দিয়ে ক্যানসারসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হতো। এতে ওষুধ উৎপাদনে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে।’

গার্মেন্টস শিল্পেও বড় ধাক্কা লেগেছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পিটি গ্রুপের এজিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ১০টি শিপমেন্ট ছিল—সবই গার্মেন্টসের কাঁচামাল। ফেব্রিকস, সুতা, ডাইং মেশিনের স্পেয়ার পার্টস সব পুড়ে গেছে। আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৯- ১০ কোটি টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সব শিপমেন্টে ইন্স্যুরেন্স ছিল, ক্ষতিপূরণ দাবি করব। কিন্তু শিল্পে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে, সেটা আর পুষিয়ে ওঠা সহজ নয়। কাঁচামাল ছাড়া পোশাক উৎপাদন সম্ভব নয়।’

গতকাল শনিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সিভিল অ্যাভিয়েশন, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সম্মিলিতভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। আগুন নেভার পর রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর পুরোপুরি চালু হয়।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025