বিমান দুর্ঘটনা ঘিরে সরকারের বিভ্রান্তি, সন্তানহারা মানুষের মনে সন্দেহ

মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমান ভেঙে পড়াকে সাদা চোখে দুর্ঘটনাই মনে হচ্ছে অধিকাংশ মানুষের, কিন্তু আইএসপিআর-এর দায়সারা বিবৃতি ও দেশের অক্যুপাইড মিডিয়ার টিআরপি বাড়ানোর নোংরা প্রচেষ্টা ‘দুর্ঘটনাটিকে’ ক্রমশ ‘প্রি-প্ল্যানড ম্যাসাকার’-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আইএসপিআর-এর প্রথম বিবৃতির শেষে বলা হয়েছে-‘উক্ত দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য ইতোমধ্যে বিমান বাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

ঘটনার ৫ দিন পরও তদন্ত কমিটি কিসের ভিত্তিতে কোন কোন সূত্র ধরে কাজ শুরু করেছে তার বিবরণ নেই। এদিকে অসমর্থীত সূত্রের খবর অনুযায়ী বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- “বিধ্বস্ত হওয়া জেটে ব্ল্যাকবক্স পাওয়া যায়নি। ওই জেটে ব্ল্যাকবক্সের বদলে নাকি ছিল CVR (Cockpit Voice Recorder) FDR (Flight Data Recorder), কিন্তু এই দুটো ডিভাইসও তারা পায়নি জেটের ধ্বংসাবশেষে।” কারণ হিসেবে বলা হয়েছে – “ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজের সময়ে সেখানে লক্ষ মানুষ গেছে, তারা কে কি নিয়ে গেছে তা বিমানবাহিনী বলতে পারে না। আবার দূর্ঘটনার সময়েও সেগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে থাকতে পারে, তারা শিওর না।”

এরপর তারা বলছে-“যদিও এগুলো পাওয়া যেত তাহলেও লাভ হতো না কারণ, এই ডিভাইস গুলোর কার্যক্রম খুবই সীমিত। FDR থেকে ইঞ্জিন পারফরম্যান্স এর তথ্য পাওয়া যাবে না শুধু জেটের গতি, উচ্চতা সম্পর্কিত অল্প কিছু তথ্য তাতে জমা থাকে। যা থেকে দূর্ঘটনার আসল কারণ নিরুপণ করা সম্ভব হতো না। আবার, CVR ও FDR খুঁজে পেলেও এগুলো এনালাইসিস করতে পাঠাতে হতো চীনে কারণ, এগুলো এনালাইসিস করার সক্ষমতা আমাদের বিমানবাহিনীর নাই।”

আগেই বলেছি; বিমান বাহিনীকে উদ্ধৃত করে এই খরবটি অসমর্থীত। সূত্রবিহীন সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত। ধরে নিলাম এই খবরটি ফেক। তার পরও ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিওগুলো দেখে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে Black box বা flight recorder-এর বদলে FDR কিংবা CVR বিধ্বস্ত বিমান থেকে কারও পক্ষে খুলে নেয়া সম্ভব না কারণ বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর পরই সেখানে সেনা-পুলিশ-ফায়ারফাইটার কর্ডন করে ফেলে। হাজার হাজার মানুষ থাকলেও তারা উদ্ধার কাজে/দৌড়াদৌড়িতে/ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিল। তাদের কারও পক্ষে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে Black box কিংবা CVR বা FDR খুলে নেয়া অসম্ভব। হতাহতদের সরিয়ে নেওয়ার পর পুরো জায়াগাটা সেনা-পুলিশের ঘেরাওতে ছিল। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশও হয়েছিল-‘বিমানবাহিনীর বিশেষজ্ঞদল আলামত সংগ্রহ করেছেন’।

তাহলে এখন কেন সেই ‘আলামতের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে’ কথাটি বলা হচ্ছে না? এর বদলে ২৪ জুলাইয়ের বিবৃতিতে আইএসপিআর বলছে – “বিএএফ শাহীন হাজী আশ্রাফ আলী স্কুল এবং ব্লু স্কাই স্কুলে গত মাইলস্টোন ট্রাজেডিতে হতাহতের জন্য বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। এ হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় যে সকল কোমলমতি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারী ও অভিভাবক প্রাণ হারিয়েছে, তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়। এছাড়া এখনও যারা ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দগ্ধ/আহত অবস্থায় মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়।”

পরদিন ২৫ জুলাই আর এক বিবৃতিতে আইএসপিআর জানায় – “বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, বিবিপি, ওএসপি, জিইউপি, এনএসডব্লিউসি, পিএসসি সস্ত্রীক মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ এর উদ্দেশ্যে ঢাকার তুরাগে গমন করেন। এ সময় তিনি শোকাহত পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেন। শুধুমাত্র বিমান বাহিনী প্রধান নয় একজন পিতা ও অভিভাবক হিসেবে তিনি শোকে কাতর পরিবারগুলোর এই কঠিন সময়ে তাদের দুঃখগুলো ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি জানান কোন ভাষায়ই এই শোক প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি এই পরিবারগুলোতে যে কোন প্রয়োজনে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন।”

অর্থাৎ এখন পর্যন্ত বিমানটির দুর্ঘটনা বিষয়ে কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি বিমান বাহিনী। কেবলমাত্র দোয়া, মুনাজাত, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, শোক প্রকাশ, পাশে থাকার আশ্বাসেই হৃদয়বিদারক ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে।

মানলাম; দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটিত করতে আরও সময় লাগবে, কিন্তু মৃতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? বিমানের পাইলট মারা গেছেন, সুতরাং মৃতের সংখ্যা ১ হোক বা ১০০ হোক নিহতদের পরিবার তো তার উপর দায় চাপাবে না। তাহলে কেন সত্য প্রকাশ করা হচ্ছে না? এটা কোনোভাবেও বিশ্বাসযোগ্য নয় যে স্কুলের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার চেক করে প্রত্যেকটি অভিভাবকের কাছে ফোন করে এক দিনেই মিসিং ডাটা পাওয়া যায় না। এটা রকেট সায়েন্স না।

একে তো মৃতের সংখ্যা জানানো হচ্ছে না, তার বদলে প্রচার করা হচ্ছে-‘সেনাবাহিনীর জীবনবাজী অভিযানে রক্ষা পেল শতাধিক প্রাণ’!

সরকারের ভাবমূর্তী নষ্ট হলো কি হলো না তা লাশের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করে জাতিকে জানান যে এটা ছিল ‘দুর্ঘটনা’, এবং মৃতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করুন। এই দুটো কাজ করতে যতো দেরি হবে ততোই মানুষের মধ্যে এমন ধারণা পোক্ত হবে যে ওটা দুর্ঘটনা ছিলো না, ছিলো দেশবিরোধী কয়েকটি এগ্রিমেন্ট, কয়েকটি ব্রুটাল কিলিং মিনিমাইজ করার ক্যামোফ্লেজ।

Tags :

Monjurul Haque

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025