ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় চলতি মাসে যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। এ যুদ্ধে উভয় দেশ নিজেদের জয়ী বলে দাবি করেছে। তবে এ সংঘাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। এতে অপ্রত্যাশিত বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে চীনা অস্ত্র ব্যবস্থার ব্যবহার এবং এর কথিত সাফল্য বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ যুদ্ধের মাধ্যমে চীনের প্রতিরক্ষা খাতের অপ্রত্যাশিত উত্থান হয়েছে।
সংঘাতের সূচনা
গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হন। এই হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং ৭ মে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এ অভিযানকে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে উল্লেখ করেছে। এরপর উভয় দেশের মধ্যে ড্রোন, মিসাইল এবং যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয়।
ভারত তার ফ্রান্স ও রাশিয়ার তৈরি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। অন্যদিকে এর মোকাবিলায় পাকিস্তান চীনের সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদিত জে-১০ এবং জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। উভয় পক্ষই দাবি করে তাদের বিমান সীমানা অতিক্রম করেনি এবং দূর থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করেছে।
পাকিস্তান দাবি করে, তারা ভারতের যুদ্ধবিমান, যার মধ্যে ফ্রান্সের তৈরি রাফাল বিমানও ছিল, ভূপাতিত করেছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ার মার্শাল এ কে ভারতি বলেন, যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি স্বাভাবিক। আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করেছি এবং আমাদের সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছে।
চীনা অস্ত্রের প্রভাব
পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানে চীনা প্রযুক্তির ব্যবহার এই সংঘাতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে আমেরিকান কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, পাকিস্তান সম্ভবত চীনের তৈরি জে-১০ বিমান ব্যবহার করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল ছুড়েছে। এই ঘটনাকে কিছু বিশেষজ্ঞ চীনা প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি ‘ডিপসিক মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটি মূলত চীনা প্রযুক্তির সাফল্যকে তুলে ধরেছে।
ভারতের সাফল্য ও কৌশল
ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানে লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদের মতো নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের সদর দপ্তর লক্ষ্য করে অন্তত ১০০ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা ১০ মে ভোরে পাকিস্তানের ১১টি বিমান ঘাঁটিতে সমন্বিত হামলা চালায়, যার মধ্যে রাওয়ালপিন্ডির কাছে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ নুর খান বিমান ঘাঁটিও ছিল।
লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও রাডার নিষ্ক্রিয় করে সুনির্দিষ্টভাবে হামলা চালিয়েছে। এই হামলাগুলো ছিল অত্যন্ত নির্ভুল। তিনি আরও বলেন, ভারতীয় পাইলটরা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও মিশন সম্পন্ন করেছে।
তবে, ভারত তার মিশনের বিস্তারিত কৌশল প্রকাশ না করায় ‘ঘটনার বর্ণনার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে,’ বলে মনে করেন ল্যাডউইগ।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান ভারতের হামলার জবাবে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে মিসাইল ও বিমান হামলা চালায়, তবে ভারত দাবি করে এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। সংঘাত তীব্র হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হস্তক্ষেপ করে উভয় দেশকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করায়।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে চীন পাকিস্তানে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল বলেন, চীনের অস্ত্র ব্যবস্থা এই সংঘাতে ভারতীয় পরিকল্পনাকারীদের জন্য একটি চমক ছিল। তারা সম্ভবত চীন-পাকিস্তানের আধুনিক যুদ্ধে সহযোগিতার গভীরতা আন্দাজ করতে পারেনি।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব
চীনা অস্ত্রের এই কথিত সাফল্য পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক, আর চীন চতুর্থ। চীন মূলত মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি করে। তবে, অতীতে চীনা অস্ত্রের গুণগত মান ও প্রযুক্তিগত সমস্যা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী জেএফ-১৭ বিমানে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে বেশ কয়েকটি বিমান ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।

Pakistan’s air base runway before-after Indian missile attack satellite image
এই সংঘাতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই নিজেদের সাফল্য দাবি করলেও ভারত যেভাবে তাদের অপরেশন সিঁদুরের স্যাটেলাইট ছবি এবং তথ্যপ্রমাণ সবার সামনে প্রকাশ করেছে পাকিস্তান সেভাবে কোন তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি তাদের দাবির প্রেক্ষিতে। ভারতের সরকারি তথ্য প্রমাণ এবং অনেক আন্তরজাতিক বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেখতে পাওয়া যায় পাকিস্তানের নয়টি জায়গার ভারতীয় মিসাইল এবং ড্রোন আক্রমণে বিমান বাহিনীর রানওয়ে, গুরুত্বপুর্ন এয়ার বেইস এবং জঙ্গি আস্তানা হিসেবে পরিচিত ঘাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।। তবে এখনো নানাভাবে চলছে এ যুদ্ধের চুলচেরা বিশ্লেষণ।