ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত: ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি

দীর্ঘ তিন বছরের আলোচনার পর অবশেষে ২৫ জুলাই ২০২৫ তারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হলো ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA)। লন্ডনের বাইরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন চেকার্সে এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার নিজ নিজ দেশের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের জন্য এটিই সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য চুক্তি, যা তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্য অংশীদারিত্ব সম্প্রসারণে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।


চুক্তির মূল বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা

এই চুক্তিকে উভয় দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য যুক্তরাজ্যের বাজারে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ। এর ফলে ভারতীয় বস্ত্র, জুতা, মূল্যবান রত্ন, গহনা, প্রক্রিয়াজাত সামুদ্রিক পণ্য, হলুদ, গোলমরিচ, আচার, ডাল, শাকসবজি, সিরিয়াল এবং রেডি-টু-ইট খাবার ব্রিটিশ বাজারে আরও সহজলভ্য হবে। বিশেষ করে, ভারতীয় কৃষকরা এতে ব্যাপক অর্থনৈতিক সুফল পাবেন।

অন্যদিকে, ভারতও যুক্তরাজ্যের ৯০ শতাংশ পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ পণ্য আগামী দশ বছরের মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। ফলে যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা স্কচ হুইস্কি, চকোলেট, গাড়ি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, কোমল পানীয় ও প্রসাধনীর মতো পণ্যের দাম ভারতে উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ব্রিটিশ হুইস্কির উপর ভারতে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক রয়েছে, যা এই চুক্তির ফলে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাবে।

অর্থনৈতিক প্রভাব ও সম্ভাবনা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বছরে প্রায় ৩৯ শতাংশ বা প্রায় ৬০০ কোটি পাউন্ড (৩৪ বিলিয়ন ডলার) বৃদ্ধি পাবে। যুক্তরাজ্য সরকার আশা করছে, ২০৪০ সালের মধ্যে এই চুক্তির মাধ্যমে বছরে অতিরিক্ত ২৫.৫ বিলিয়ন পাউন্ড বাণিজ্য করা সম্ভব হবে। চুক্তিটিকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, এটি যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগ উন্মোচন করবে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটিকে ‘উভয় দেশের সমৃদ্ধির নকশা’ এবং ‘মোদি ইন্ডিয়া’-র জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, বস্ত্রশিল্প, কৃষি পণ্য, মৎস্য শিল্প এবং ভারতীয় পেশাদারদের মতো বিভিন্ন খাতে এই চুক্তির ফলে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি আসবে। ভারতীয় উদ্যোক্তা এবং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য যুক্তরাজ্যে উন্নত ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগও সহজ হবে। এরই মধ্যে, ২৬টি ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে, যা এই চুক্তির অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব

এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি এমন এক সময়ে সম্পাদিত হলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নবগঠিত বাণিজ্য নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছে এবং অনেক দেশে শুল্কযুদ্ধ ও বাণিজ্য বাধা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত-যুক্তরাজ্য FTA বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মুক্ত বাণিজ্যের গুরুত্বের উপর পুনরায় জোর দিচ্ছে। এটি শুধু দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করবে না, বরং বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে স্থিতিশীলতা ও নতুন প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে, চুক্তিটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। উভয় দেশের মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদনের পরই এটি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হবে, যা সম্পূর্ণ হতে প্রায় আরও এক বছর সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, এই চুক্তি ভারত ও যুক্তরাজ্যের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে উভয় দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা একমত।

Tags :

International News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025