তিয়ানজিন, চীন: চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) জোটের বৈঠকের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একমত হয়েছেন যে, দুই দেশ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং উন্নয়নের অংশীদার। রবিবার (৩১ আগস্ট, ২০২৫) এই দুই শীর্ষ নেতা বৈশ্বিক শুল্কনীতির অনিশ্চয়তা নিয়েও আলোচনা করেন।
সাত বছর পর মোদির চীন সফর
সাত বছর পর এই প্রথম নরেন্দ্র মোদি চীন সফরে গেলেন। এই সফরের উদ্দেশ্য, বৈশ্বিক শুল্কনীতির অনিশ্চয়তার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ককে উন্নত করা। এই সম্মেলনে মোদি ছাড়াও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরান, পাকিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার চারটি দেশের নেতারা উপস্থিত ছিলেন, যা ‘গ্লোবাল সাউথ‘ হিসেবে পরিচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঐক্যের এক প্রতীকী প্রদর্শন।
পশ্চিমা চাপের মুখে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভারতের পণ্যের ওপর ৫০% শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে শি এবং মোদি পশ্চিমা চাপের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরি করতে চাইছেন। উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন চেয়েছিল যে ভারত বেইজিংয়ের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বৈঠকে মোদি বলেন, পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস ও সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি চীনের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৯৯.২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়েও আলোচনা করেন। মোদি আরও বলেন, ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর সৃষ্ট উত্তেজনা এখন অনেকটা কমেছে এবং সীমান্তে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতার’ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
চীন ও ভারত একে অপরের জন্য হুমকি নয়, বরং উন্নয়নের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র—এমনটাই বলেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি উভয় পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন যেন সীমান্ত সমস্যা দুই দেশের সামগ্রিক সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। শি আরও বলেন, যদি দুই দেশ একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে অংশীদার হিসেবে দেখে, তাহলে চীন-ভারত সম্পর্ক ‘স্থিতিশীল ও সুদূরপ্রসারী’ হতে পারে।

সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পথে
২০২০ সালে সীমান্ত সংঘর্ষের পর ভারত ও চীনের সম্পর্ক চরম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ওই সংঘর্ষে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি লড়াইয়ে ২০ জন ভারতীয় এবং চারজন চীনা সৈন্য নিহত হন। এরপর থেকে হিমালয়ের এই সীমান্ত এলাকায় উভয় দেশই অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে। তবে গত বছর একটি টহলদারী চুক্তির পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি সাংবাদিকদের জানান, সীমান্তের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, মোদি ও শি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পুনরায় সরাসরি ফ্লাইট এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
মোদি জানান, ২০২০ সাল থেকে স্থগিত থাকা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট আবার চালু হচ্ছে, যদিও এর নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা তিনি জানাননি। এই মাসেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র ভারত সফরের সময় চীন বিরল মৃত্তিকা, সার এবং টানেল বোরিং মেশিনের উপর থেকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয়েছিল।
সম্পর্কে পুরোনো সমস্যা এখনো বিদ্যমান
তবে, সম্পর্কের মধ্যে কিছু দীর্ঘদিনের সমস্যা এখনও রয়ে গেছে:
- বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি: চীন ভারতের সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অংশীদার হলেও, ভারতের জন্য তা ক্রমাগত হতাশার কারণ। এই বছর ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড ৯৯.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
- তিব্বতে বাঁধ নির্মাণ: তিব্বতে চীনের একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা নিয়ে ভারত সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ভারতের অনুমান, এই বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের জলপ্রবাহ প্রায় ৮৫% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
- অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যু: ভারত তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে, যাকে বেইজিং একজন বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেখে। এছাড়া, ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা পেয়ে থাকে।
এই সমস্যাগুলো এখনো বিদ্যমান থাকলেও, সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারত ও চীন কৌশলগত কারণে একে অপরের কাছাকাছি আসছে।