বাংলাদেশি পাসপোর্টে মিলছে না ভিসা

একসময় ধারণা ছিল, যত বেশি দেশ ভ্রমণ করা যাবে এবং পাসপোর্টে যত বেশি দেশের ভিসা থাকবে, পাসপোর্ট তত বেশি ‘ভারী’ হবে। উন্নত দেশগুলো সহজে ভিসা দেবে। তবে, দিন বদলে গেছে। বর্তমানে সবুজ মলাটের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অধিকাংশ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেরই যেন ‘অ্যালার্জি’। ভিসা দেওয়া তো দূরের কথা, যেসব দেশে ভিসা ‘অন-অ্যারাইভাল’ নিয়ম চালু আছে, সেসব দেশও বাংলাদেশিদের প্রবেশ করতে না দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো জনপ্রিয় গন্তব্যেও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা পাওয়া কঠিন হচ্ছে। এসব দেশের ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সময় দীর্ঘ হচ্ছে, প্রত্যাখ্যানের হার বাড়ছে এবং পুরোনো সুবিধাগুলো সীমিত করা হচ্ছে। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ভিসা পেলেও অনেক বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীকে ইমিগ্রেশনে নানা কারণে ‘অফলোড’ করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

পাসপোর্টের গুরুত্ব কমে যাওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যখন নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটননির্ভর দেশগুলোও বাংলাদেশিদের বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়। অথচ এসব দেশে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণসাপেক্ষে ভিসা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা চালু আছে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে বিমানবন্দর থেকে মুহূর্তেই ভিসা দেওয়ার কথা।

একসময় বিনামূল্যে অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া ইন্দোনেশিয়া এখন সহজে ভিসা দিচ্ছে না। ভিসার জন্য অনেক নথিপত্র ও ফি প্রয়োজন হচ্ছে, তবুও ভিসা নিশ্চিত নয়। এছাড়া, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ভারত নতুন করে ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। বর্তমানে দীর্ঘ যাচাই-বাছাই করে কেবল মেডিকেল ভিসা দেওয়া হলেও সামান্য ত্রুটি পেলেই অফলোড করা হচ্ছে।

সম্প্রতি দুবাই ও আবুধাবির মতো মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশও নতুন করে ভিসা প্রদান স্থগিত রেখেছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টের ওপর যেন ভরসা পাচ্ছে না কেউই। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশি পাসপোর্টের প্রতি অনীহা আসার অন্যতম কারণ হলো ভিসার অপব্যবহার ও অবৈধ অভিবাসন। অনেকেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই-আবুধাবিতে পর্যটন ভিসা নিয়ে প্রবেশ করে আর দেশে ফেরেন না। তারা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও লুকিয়ে কাজ করেন অথবা গ্রেপ্তার হয়ে দেশে ফেরেন।

এছাড়া, কিছু দেশ অভিযোগ করছে যে বাংলাদেশি পর্যটক বা সাধারণ ভিসাধারীরা এই রুট ব্যবহার করে অবৈধভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

চলতি বছরের ১১ জুলাই ৯৬ জন, ১৩ জুলাই ১২৩ জন, ২৬ জুলাই ৮০ জন এবং আগস্ট মাসের এক দিনে সর্বোচ্চ ৯৮ জন বাংলাদেশিকে বিমানবন্দরে আটকে পরবর্তী ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশের বরাত দিয়ে দেশটির দৈনিক দ্য স্ট্রেইটস টাইম জানিয়েছে, পর্যটন ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের অন্যতম শর্ত হলো বৈধ হোটেল বুকিংয়ের কাগজপত্র সঙ্গে রাখা। ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিদের হোটেল বুকিং সন্দেহজনক ছিল; তারা এ বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছিলেন না। এছাড়া, তাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত ভ্রমণকালীন অর্থও ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে পর্যটন ভিসায় আসা যাত্রীরা আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার কথা জানালেও আত্মীয়ের আমন্ত্রণপত্র বা ঠিকানা দিতে ব্যর্থ হন। এসব অসঙ্গতির কারণে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয় যে যাত্রী হয়তো অবৈধভাবে কাজ করতে এসেছেন।

বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশন শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা অনেক বাংলাদেশিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, দালালরা তাদের ভুল বুঝিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় কাজের জন্য পাঠায়। তারা অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পার হওয়ার জন্য যাত্রীদের নানা রকম বেআইনি কৌশল শিখিয়ে দেয়। যেমন— আশপাশের যাত্রীরা অফলোড হলে লাইন থেকে পিছু হটে বিমানবন্দরের বিশ্রামাগারে লুকিয়ে থাকা এবং শিফট পরিবর্তনের পর আবারও লাইনে দাঁড়ানো। এমন অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণেই মালয়েশিয়া বর্তমানে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখলে অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে।

শুধু কাজের উদ্দেশ্যে নয়, মালয়েশিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে অনেকে লিবিয়া হয়ে ইতালিসহ ইউরোপের নানা দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। পর্যটননির্ভর দেশ থাইল্যান্ড প্রতিবেশী ভারতীয়দের ভিসা অন-অ্যারাইভালের সুযোগ দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশিদের কাছ থেকে একগাদা নথিপত্র নিয়েও মাসের পর মাস সময় নিচ্ছে ভিসা দিতে। পাসপোর্টের কপির সঙ্গে আবেদনকারীর ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সলভেন্সি সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স, অফিসের অনাপত্তিপত্রসহ ডজনখানেক নথিপত্র জমা নেয় তারা। কাগজে-কলমে ভিসা পেতে সাত থেকে ১০ কার্যদিবস লাগলেও বর্তমানে তা ৪৫ দিনে গিয়ে ঠেকেছে।

ট্যুর অপারেটররা অভিযোগ করেছেন, বর্তমানে থাইল্যান্ড ই-ভিসা চালু করেছে। যে কেউ নিজেই নিজের ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে, বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ উঠেছে। নতুন পাসপোর্টে ভিসা দেওয়া, না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় ৪৫-৫০ দিন সময় নিচ্ছে দেশটি। অনেক ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি সময় নিচ্ছে। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকের ট্যুর ভেস্তে যাচ্ছে।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025