চলতি (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৯৮,৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশী। এই ঋণ প্রবৃদ্ধির হার গত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এটি একটি অর্থনৈতিক প্যারাডক্স তৈরি করেছে যা গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এডিপি বাস্তবায়ন: দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন
সিপিডির বরাত দিয়ে আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়কালে এডিপি বাস্তবায়ন হার মাত্র ৩২.৮ শতাংশ। এই অংক গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশেষত, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হার ৩১.১ শতাংশ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণ-প্রকল্পগুলোর হার ৩৫.৬ শতাংশ।
সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত শীর্ষ দশ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পাঁচটির এডিপি বাস্তবায়ন হার জাতীয় গড়ের নিচে অবস্থান করছে। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো, শীর্ষ দশের বাইরের মন্ত্রণালয়সমূহের গড় এডিপি বাস্তবায়ন হার পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে – ৪২.৪ শতাংশ থেকে ২১.৭ শতাংশে।
সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সামগ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন হার ৩৪.৫ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী বছরের ৩২.৪ শতাংশের তুলনায় মাত্র ২.১ শতাংশ বৃদ্ধি। এই প্রান্তিক উন্নতি ঋণ বৃদ্ধির হারের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ঋণ বৃদ্ধির অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও এডিবির সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ এই পরিস্থিতির বিশ্লেষণে বলেন, “সরকারি ঋণের প্রাথমিক কারণ সাধারণত বাজেট ঘাটতি পূরণ। তবে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের দুর্বল অবস্থা এবং অনুন্নয়ন বাজেটে কোনো অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি না থাকায় এই বিপুল ঋণ গ্রহণের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সরকারের অর্থায়নের প্রচলিত উৎসগুলো সংকুচিত হয়েছে। রাজস্ব আদায় হ্রাস এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রয়ে নেতিবাচক প্রবাহ সরকারকে ব্যাংক ঋণের উপর অধিক নির্ভরশীল করে তুলেছে।
রাজস্ব আদায় ও সঞ্চয়পত্রের বিশ্লেষণ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে রাজস্ব আদায় ৭১,৪৭৬ কোটি টাকা। তবে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সঞ্চয়পত্র খাতে নেট নেগেটিভ ক্যাশ ফ্লো ৭,০১৩ কোটি টাকা।
এরকম নেগেটিভ ক্যাশ ফ্লো তখনি দেখা যায় যখন জনগণ নতুন সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের চেয়ে নিজেদের কাছে থাকা সঞ্চয়পত্র ভেঙে খরচ করেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক, যা ভোগব্যয় বৃদ্ধি এবং সঞ্চয় হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
বর্তমান পরিস্থিতি বেশ কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দেয়:
প্রথমত, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে পরিবারগুলো তাদের সঞ্চয় ভেঙে ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ ও পুঁজি গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দ্বিতীয়ত, ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা অবস্থা রাজস্ব আদায় হ্রাসের কারণ। এটি সরকারের অর্থায়ন ক্ষমতা সীমিত করছে।
তৃতীয়ত, উন্নয়ন ব্যয়ের দুর্বল বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ন করছে।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই ধরনের পরিস্থিতি অপরিচিত নয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্বেগজনক দিক হলো ঋণ বৃদ্ধির সাথে উৎপাদনশীল ব্যয় বৃদ্ধির সামঞ্জস্যহীনতা।
প্রকৃত অর্থে, এই পরিস্থিতি ‘ফিসক্যাল ডোমিনেন্স’ এর একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে সরকারি ঋণ দেশের মুদ্রানীতি ও আর্থিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের মতো সীমিত আর্থিক বাজারের দেশে সরকারি ঋণের এই দ্রুত বৃদ্ধি বেসরকারি বিনিয়োগে ‘ক্রাউডিং আউট’ (সরকারের অতিরিক্ত ঋণগ্রহণের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া) ইফেক্ট সৃষ্টি করতে পারে। য এইমুহুর্তে আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি।
নীতিগত প্রভাব
এই পরিস্থিতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত প্রভাব রয়েছে:
ঋণের স্থায়িত্ব: দ্রুত ঋণ বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদী ঋণের স্থায়িত্বের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত যদি এই ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না হয়।
আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা: সরকারি ঋণের দ্রুত বৃদ্ধি ব্যাংকিং খাতের তারল্য ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
মুদ্রানীতির কার্যকারিতা: বৃহৎ পরিমাণ সরকারি ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি পরিচালনায় জটিলতা সৃষ্টি করে।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ইঙ্গিত
এডিপি বাস্তবায়নের দুর্বল হার দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। এটি কেবল অর্থের অভাবের সমস্যা নয়, বরং প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়নের সমগ্র প্রক্রিয়ার দুর্বলতার নির্দেশক।
বিশেষত, শীর্ষ দশ মন্ত্রণালয়ের অর্ধেকের কর্মক্ষমতা গড়ের নিচে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় ও পরিকল্পনার দুর্বলতা নির্দেশ করে।
এইরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি নীতিগত পদক্ষেপ বিবেচনা করা হয়; যেমন-
- ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য ও ব্যবহারের বিস্তারিত হিসাব প্রকাশ
- এডিপি বাস্তবায়নে বাধাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও দূরীকরণ
- প্রকল্প পরিকল্পনা ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ
- বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি
- আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি
- প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন
বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দেয়। ৬০ শতাংশ ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি এডিপি বাস্তবায়নে দশকের সর্বনিম্ন কর্মক্ষমতা একটি অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যেরও নির্দেশক।
এই পরিস্থিতি কেবল একটি সাময়িক আর্থিক সমস্যা নয়, বরং এটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে।
অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা ঋণের স্থায়িত্ব, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
অতি দ্রুত একটি স্থিতিশিল সরকার না আসলে বাংলাদেশ একটি গভীর আর্থিক সংকটের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।