ময়মনসিংহে অবস্থিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের শতাব্দী প্রাচীন পৈতৃক বাড়িটি ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এটি একসময় ময়মনসিংহ শিশু একাডেমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা শিশুদের বিকাশের জন্য একটি সরকারি কেন্দ্র। এক দশক ধরে অবহেলার কারণে কাঠামোগত নিরাপত্তার উদ্বেগ দেখিয়ে কর্মকর্তারা বাড়িটিকে একটি নতুন আধা-কংক্রিট কাঠামো দিয়ে প্রতিস্থাপন করছেন।
এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বাড়িটি ভাঙার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নির্মিত এই জমিদার বাড়িটি ৩৬ একর সুবিশাল জায়গার ওপর অবস্থিত। এই বাড়িটি কয়েক প্রজন্মের সাংস্কৃতিক প্রতিভাদের সংযোগস্থল। উপেন্দ্রকিশোর নিজেই ছিলেন বাংলার নবজাগরণের একজন অগ্রণী লেখক, প্রকাশক এবং প্রযুক্তিবিদ, যিনি মূলত শিশুদের পত্রিকা সন্দেশ প্রতিষ্ঠা এবং ভারতে উন্নত হ্যালফটোন মুদ্রণ কৌশল প্রবর্তনের জন্য পরিচিত। তাঁর পুত্র সুকুমার রায় ছিলেন একজন জনপ্রিয় কবি ও ব্যঙ্গকার, যার ছড়া বাংলা সাহিত্যে গভীরভাবে প্রভাবশালী। তাঁর পৌত্র সত্যজিৎ রায় বিশ্বসিনেমার অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই বাড়ি ভাঙার ঘটনায় ‘গভীর দুঃখ’ প্রকাশ করেছে এবং ভবনটি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক উভয় প্রকার সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাড়িটি বাংলা সাংস্কৃতিক নবজাগরণের প্রতীক। তাই এটি ভেঙে ফেলার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। এটি একটি সাহিত্য জাদুঘর। একে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে দেখলে ভালো হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এক্স (পূর্বে টুইটার) এ বাংলা ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ওই বাড়িটি ভাঙার খবর অত্যন্ত দুঃখজনক।
রায় পরিবারকে বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান মশালবাহক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ সরকার এবং সেই দেশের সকল বিবেকবান মানুষের কাছে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। ভারত সরকারেরও এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায় জানিয়েছেন, এই নির্মাতা তাঁর পৈতৃক বাড়ির ছবি একটি ডকুমেন্টারিতে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে তা বাতিল করেন।
সন্দীপ রায় বলেন, ‘আমি এই ভবনটি দেখতে বাংলাদেশে যাইনি, বাবাও (সত্যজিৎ রায়ও) যাননি। আমি যা দেখেছি তা ছিল ভবনটির ছবি। কিন্তু আমার মনে আছে, বাবা ডকুমেন্টারি নিয়ে কাজ করার সময় এই ভবনের ছবি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী, যিনি বাবার প্রযোজনা দেখভাল করতেন, তাকে এই ভবনের কিছু ছবি তোলার জন্য বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বাবা ভবনটিকে জরাজীর্ণ অবস্থায় দেখে খুব হতাশ হয়েছিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর ডকুমেন্টারিতে সেই ছবিগুলো ব্যবহার করবেন না।
এদিকে, সম্প্রতি রায় পরিবারের বাড়ি ভাঙার একটি ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন ও নিন্দা জানান।
অর্থনীতিবিদ সঞ্জীব সান্যাল এক্স-এ লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভাঙচুর করার সময় তারা নীরব ছিল। সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলার সময়ও তারা নীরব। প্রকৃতপক্ষে, তারা বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুর পরিচয় পদ্ধতিগতভাবে মুছে ফেলার সাথে জড়িত।’
সূত্র : ইন্ডিপেন্ডেন্ট, যুক্তরাজ্য