২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। গত বছর নিট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২৩ সালে নিট এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্টে বিদেশি বিনিয়োগ আসার ওই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে আঙ্কটাড ‘ওয়ার্ল্ড ইনেভেস্টমন্ট রিপোর্ট-২০২৫’ নামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাকি দেশের পরিসংখ্যান ওই প্রতিবেদনে রয়েছে।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। গত বছর যে পরিমাণ এফডিআই এসেছে, তা মাত্র এক মাসে রেমিট্যান্সের অর্ধেক এবং রপ্তানি আয়ের চার ভাগের এক ভাগ।
একটি নির্দিষ্ট বছরের মোট বিদেশি বিনিয়োগ বলতে বাইরের উদ্যোক্তাদের থেকে নতুন পুঁজি, বিদ্যমান বিনিয়োগের মুনাফা থেকে পুনর্বিনিয়োগ এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণের সমষ্টিকে বোঝানো হয়। একই সময়ের মধ্যে পুঁজি প্রত্যাহার, মূল কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিনিয়োগের হিসাব করা হয়।
বাংলাদেশে ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার, যা দেশের জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে গড় হার ১৩ শতাংশ। ভারতের হার ১৪ শতাংশ। ভুটানের মতো দেশে এ হার ১৭ শতাংশ। গত বছর ভুটানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ গুণ।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) অর্থের ঘোষণার পরিমাণও কমেছে। ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ১৭৫ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৭০ কোটি ডলার। গত বছর কমে যাওয়ার হার ৩৫ শতাংশ। গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগের ঘোষণা ভবিষ্যতের প্রকৃত বিনিয়োগের ইঙ্গিত দেয়।
বিনিয়োগ কেন কম
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের নিম্ন প্রবণতার কারণ জানতে চাইলে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও এমডি জাভেদ আখতার বলেন, একজন বিনিয়োগকারী তখনই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন, যখন তিনি বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোর ওপর ভরসা পান। বিনিয়োগের পরিবেশ ব্যবসাবান্ধব হয়। দুঃখজনক হলেও এটি স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশের বিনিয়োগের পরিবেশ কখনোই ভালো ছিল না। এর অন্যতম কারণ হলো, দেশের অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার বিশ্বাসযোগ্যতা, রাষ্ট্রের বিনিয়োগ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার অভাব। এর ওপর গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেনি।
ফিকি সভাপতির মতে, গত ১০ মাসে সরকার যদিও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তার ফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে, অথর্নীতির চাকা সচল না হলে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত বিনিয়োগের আশা করা শুধু অযৌক্তিক নয়, দুরূহ হবে।
তিনি বলেন, দেশীয় বাজার এবং রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থান ভালো। কিন্তু উল্লিখিত তিনটি কারণের জন্য আমরা পিছিয়ে রয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব বিষয় খতিয়ে দেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগুলোর প্রতিকার না করা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীর আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশের ওপর কখনোই আসবে না।
বাংলাদেশিদের বাইরে বিনিয়োগ কত
আঙ্কটাড শুধু দেশওয়ারি বিনিয়োগ আসার তথ্য প্রকাশ করে না। কোনো দেশ থেকে বাইরে কী পরিমাণ বিনিয়োগ হয়, তার তথ্যও দেয়। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিদেশে মাত্র ৭০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে দেশের বাইরে সর্বাধিক ৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। ২০২৪ সাল শেষে বিদেশে বাংলাদেশিদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় যা ৮ শতাংশ কম।
বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি
২০২৪ সালে প্রকৃত বৈশ্বিক বিনিয়োগ ১১ শতাংশ কমে দেড় ট্রিলিয়ন ডলারে নেমেছে। যদিও কিছু অন্থায়ী আর্থিক প্রবাহের কারণে সামগ্রিক চিত্রে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ২০২৫ সালেও পরিস্থিতি নেতিবাচক থাকতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে আঙ্কটাড। বাণিজ্য উত্তেজনা, নীতি অনিশ্চয়তা এবং ভূরাজনৈতিক বিভক্তি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করছে সংস্থাটি। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের মতোই। ভারতে এফডিআই কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।