রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে ও পরে সংঘাত-সহিংসতা এবং সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অনেক কলকারখানা বন্ধ হওয়ার মধ্যে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। এ তথ্য উঠে এসেছে সরকারি পরিসংখ্যানে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে দেশে মোট বেকার ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার। এই হিসেবে এক বছরেই বেকারত্ব বেড়েছে প্রায় ৬.৫০ শতাংশ।
রোববার বিবিএসের প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৪ এ এই তথ্য উঠে এসেছে।
এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরে বেকারত্বের হার ৩.৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.৬৫ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে কৃষি, সেবা ও শিল্প খাতে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমেছে। নারীর তুলনায় পুরুষ বেকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, বেকারত্ব বেড়েছে, তবু কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী প্রায় আড়াই শতাংশ এবং যুব শ্রমশক্তি ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। যদিও দেশের জনসংখ্যা এই বছরে ১ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ কাজ করে কৃষি খাতে। এর পরেই রয়েছে সেবা ও শিল্পখাত।
বেকারত্ব কেন বাড়ল?
বিবিএসের প্রতিবেদনে বেকারত্ব বৃদ্ধির কোনো সরাসরি ব্যাখ্যা না দিলেও বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে কারণগুলো ধরা যায়।
গত বছরের জুলাই থেকে আগস্টের আন্দোলন এবং সরকার পতনের পর শিল্প খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের পরিবারের কোম্পানি বেক্সিমকো গ্রুপের ১৪টি পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, যার ফলে ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
বিজিএমইএ-এর তথ্য মতে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬৯টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, যার ফলে ৭৬ হাজার ৫০৪ শ্রমিক বেকার হয়েছে।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪২টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭টি স্থায়ীভাবে এবং ৭৭টি সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।
গত ৯ মাস ধরে কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ একটি নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিক জাহিদ হোসেন বলেন, “রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনও কাটেনি, বরং কিছু ক্ষেত্রে বাড়ছেই। এ কারণে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে।” তিনি আরও বলেন, “২০২৪ সালের আগস্টে বন্যার প্রভাব পড়েছিল কৃষি খাতে, যা শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার একটি কারণ।”
তিনি আশা করছেন, চলতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় কৃষিখাত ঘুরে দাঁড়াবে, তবে বিনিয়োগের মন্দা ও শিল্প উৎপাদনের স্থবিরতা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদনটি পাঠানো হলে অর্থনীতির গবেষণা সংস্থা সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিক খান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “দেখে মনে হচ্ছে নারীদের কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় এই হারটা বেড়েছে। এখানে প্যারামিটারগুলো নেই। কোথায় কমল বাড়ল সেটি বোঝা যাচ্ছে না।”
বিনিয়োগের পরিস্থিতির যদি দ্রুত উন্নতি না ঘটে কর্মসংস্থান আরও কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
পুরুষের মধ্যে বেকারত্ব বেশি
জরিপের তথ্য বলছে, নারীদের তুলনায় পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি। দেশে পুরুষ বেকার ১৮ লাখ, আর নারী বেকার ৮ লাখ ২০ হাজার। পুরুষদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩.৭৫ শতাংশ, নারীদের মধ্যে ৩.৪৬ শতাংশ।
বেকার কারা?
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও নীতিমালাই বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করে। এই নীতিমালা অনুযায়ী যারা বিগত ৭ দিন সময়ে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে অথবা খানার নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদন করেছে তারাই কর্মে নিয়োজিত।
অর্থাৎ যারা গত ৭ দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা মজুরি বা আয়জনিত কাজ করেননি, তাদের বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়।
কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমেছে
জনসংখ্যা বাড়ার বিপরীতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমেছে। ২০২৪ সালের শেষে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছিল ৭ কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজার, যা এক বছর আগের ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজারের তুলনায় ১৭ লাখ ২০ হাজার কম। অর্থাৎ এক বছরে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমেছে ২.৩৪ শতাংশ।
যুব শ্রমশক্তিও কমেছে। ২০২৪ সালে যুব শ্রমশক্তি ছিল ২ কোটি ২৬ লাখ, যা আগের বছর ছিল ২ কোটি ৬৭ লাখ, অর্থাৎ ৪১ লাখ বা ১৫.৩৫ শতাংশ কম।
তবে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১.১ শতাংশ বা সাড়ে ১৭ লাখ বেড়েছে।
জনসংখ্যা বাড়লেও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমার ব্যাখ্যা জরিপ প্রতিবেদনে নেই।
জরিপ কাদের নিয়ে?
দেশব্যাপী ১,২৮৪টি নমুনা এলাকায় দৈবচয়নভিত্তিক ২৪টি করে পরিবারের তথ্য নেওয়া হয়েছে। মোট ৩০,৮১৬টি পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
৬৪টি জেলায় ৫৭ জন নারী ও ৫০ জন প্রশিক্ষিত পুরুষ মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
জরিপে লিঙ্গভিত্তিক কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, শ্রম অভিবাসন ব্যয়, পেশাভেদে শ্রমশক্তি, কর্মঘণ্টা ও মজুরিসহ বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রস্তুত করা হয়।