বায়ুদূষণ এখন বাংলাদেশের মানুষের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিকের গড় আয়ু থেকে সাড়ে পাঁচ বছর কমে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিক) প্রকাশিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই) ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানদণ্ড ও দেশের নিজস্ব মানদণ্ডের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি ৬৮ লাখ মানুষ এমন এলাকায় বসবাস করছে যেখানে বাতাসের মান ডব্লিউএইচও-এর মানদণ্ডের তুলনায় ভয়াবহভাবে দূষিত। এমনকি সবচেয়ে কম দূষিত জেলা লালমনিরহাটেও ডব্লিউএইচও-এর নির্ধারিত মানের তুলনায় সাত গুণ বেশি দূষণ রয়েছে।
১৯৯৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পিএম ২.৫) এর ঘনত্ব বেড়েছে ৬৬ শতাংশেরও বেশি। এর ফলে গড় আয়ু থেকে অতিরিক্ত ২ দশমিক ৪ বছর কমে গেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বায়ুদূষণ প্রত্যেক বাংলাদেশির জীবনের বছর কেড়ে নিচ্ছে। এর প্রভাব ধূমপান, অপুষ্টি কিংবা অস্বাস্থ্যকর পানি—সব মিলিয়েও যতটা হয়, তার চেয়েও মারাত্মক।’
তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ধূমপান গড় আয়ু কমায় প্রায় ২ বছর, আর শিশুপুষ্টি ও মাতৃপুষ্টির ঘাটতি গড় আয়ু কমায় ১ দশমিক ৪ বছর। কিন্তু বায়ুদূষণের প্রভাব এর চেয়েও গভীর।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদি ঢাকার বায়ুদূষণ ডব্লিউএইচও মানদণ্ডে নামিয়ে আনা যায়, তবে রাজধানীবাসীর গড় আয়ু বেড়ে যাবে প্রায় ৬ দশমিক ৯ বছর। এমনকি দেশের জাতীয় মানদণ্ড—৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার—পূরণ হলেও ঢাকাবাসীর গড় আয়ু অন্তত ৪ বছর বাড়তে পারে।
এদিকে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মতো জেলাগুলোর অবস্থা আরও উদ্বেগজনক। এসব অঞ্চলে ডব্লিউএইচও-এর মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারলে মানুষের গড় আয়ু বাড়বে সাড়ে ৬ বছরেরও বেশি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভয়াবহ পরিস্থিতি সত্ত্বেও নীতি ও পদক্ষেপ এখনো অত্যন্ত দুর্বল। ঢাকার আশপাশের ইটভাটাগুলো বহুদিন ধরে দূষণের প্রধান উৎস হলেও সেগুলো কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি পুরোনো বাস ও ট্রাক থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং শিল্পকারখানার অযাচিত নির্গমনও দূষণকে আরও ঘনীভূত করছে।
শুধু দেশীয় উৎসই নয়, প্রতিবেশী দেশ থেকেও মৌসুমি ধোঁয়াশা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। অথচ এ বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় জনবল ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আইন থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
একিউএলআই তাদের প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, ‘এটি কেবল নিয়ন্ত্রণহীনতার ব্যর্থতা নয়, বরং একটি চলমান জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়।’