বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে প্রবীণ কবি, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক এবং এনজিও পরিচালক ফরহাদ মজহারের একটি মন্তব্যে। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সদ্যপ্রয়াত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মরণে আয়োজিত এক আলোচনা ও ইফতার সভায় তিনি দেশের ভবিষ্যৎ সরকার পরিবর্তন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এই সভার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে ব্যানারে লেখা ছিল ‘সংকট উত্তরণে যুব সমাজের ভূমিকা‘। সভায় তার করা মন্তব্য বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে যখন দেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়ে নানা জল্পনা চলছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ফরহাদ মজহারের ইঙ্গিত:
ওই অনুষ্ঠানে ফরহাদ মজহার সরাসরি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, “সরকার বদল করতে আপনাদের (জনগণ) লাগবে না, ওটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করে দেবে।” তাঁর এই বক্তব্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এটি এমন এক সময়ে বলা যখন বাংলাদেশের নির্বাচন ও সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের, বিভিন্ন পদক্ষেপ ও মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত।
সরকার সরানোর চেষ্টা এবং গণঅভ্যুত্থানের প্রক্রিয়া:
নিজের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ফরহাদ মজহার আরও বলেন, “তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ইতোমধ্যে সরকার সরাতে চেষ্টা করছে।” এই মন্তব্য তৎকালীন সরকারের ওপর বিদেশি চাপ এবং তাদের কথিত ক্ষমতাচ্যুতির প্রচেষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে। একই সাথে তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে সরকারের পরিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, “সরকার কীভাবে বদলায়, দুনিয়াতে বিভিন্ন দেশে কীভাবে বদলানো হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে, প্রক্রিয়াগুলো কী, এগুলো আপনাদের বুঝতে হবে।” এর মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন বিদেশি হস্তক্ষেপের কথা বলছেন, তেমনি অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে গণঅভ্যুত্থানের বা বিভিন্ন দেশে সংঘটিত কালার রেভুলেশনের প্রেক্ষাপট বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন। এটি জনগণের মধ্যে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে একটি সচেতনতামূলক আলোচনার ইঙ্গিত দেয়।
ফরহাদ মজহারের বিতর্কিত ভূমিকা ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:
ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে তার স্বতন্ত্র এবং প্রায়শই বিতর্কিত অবস্থানের জন্য পরিচিত। তিনি বিভিন্ন সময়ে তার লেখালেখি, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচনা ও সমালোচনার শিকার হয়েছেন। সাম্প্রতিককালে দেশের রাজনৈতিক ডামাডোলে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ার দাবি এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তিনি এই ধারণার একজন দৃঢ় সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
মন্তব্যের প্রভাব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ:
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফরহাদ মজহারের এই ধরনের মন্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে। যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ বা বয়ান আলোচনায় রয়েছে, তখন তাঁর এই সরাসরি মন্তব্য সেই ধারণাটিকে আরও জোরালো করবে। তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিদেশি প্রভাবের ধারণা আরও বেশি আলোচিত হবে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ফরহাদ মজহারের জীবনসঙ্গিনী ফরিদা আখতার বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার পতন আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় উপস্থাপন করেছেন।
এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় এবং গঠনের পরেও বিভিন্ন সভায় তার সক্রিয় উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। এটি ফরহাদ মজহারের বক্তব্যকে তার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত করে দেখার একটি সুযোগ তৈরি করে।
সব মিলিয়ে, ফরহাদ মজহারের এই বক্তব্য দেশের চলমান রাজনৈতিক বিতর্ক এবং ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
নীচে সেই সভার ভিডিওর অংশবিশেষ দেওয়া হলো