৮ অক্টোবর, বুধবার গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের হওয়া দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩০ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে ১৪ জন কর্মরত এবং ১০ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। বাকিরা হলেন- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। এবং র্যাবের দুইজন সাবেক মহাপরিচালক। আগামী ২২শে অক্টোবরের মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই দুঃসাহসিক কাজটি করার আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ‘এক্তিয়ার আছে’ মর্মে ICT আইন বানিয়ে নিয়েছে।
পরোয়ানা জারির আদেশের মাত্র দুইদিন আগে গত সোমবার রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের, ১৯৭৩-এ (২০-সি) সংশোধন করে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
প্রসিকিউটররা বলছেন, ‘এই প্রজ্ঞাপনের কারণে ফৌজদারি অপরাধের মামলায় যেসব সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হবেন, তারা আর সরকারি চাকরির কোনো পদে বহাল থাকতে পারবেন না।‘
এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে; সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ওঠে তাহলে সামরিক বাহিনীর নিজস্ব আইনে সামরিক আদালতে, নাকি প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করা যাবে?
সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের এই আইনগত বিষয়ে ISPR-এর কাছে জানতে চাইলে “কোনো মন্তব্য নেই” বলে জানানো হয়েছে।
১১ তারিখে সেনা সদর থেকে ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে―সেনাবাহিনী ‘বাহিনী হিসাবে’ গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত নয়।‘
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীমের মতে, ‘সংবিধান ও ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার ট্রাইব্যুনালে হতে বাধা নেই।‘ সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মতে ‘বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থায় এ ধরনের মামলার আরও উদাহরণ আছে। এর আগে ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় তৎকালীন তিনজন সেনা কর্মকর্তা, যারা র্যাবের অধীনস্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। সে সময় তাদের সেনাবাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয়েছিলো। পরে সাবেক ওই তিন কর্মকর্তার বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই হয়।’
সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী জানান, ফৌজদারি অপরাধের মামলা প্রচলিত আদালতে সাধারণত দায়ের করা হয়।
‘ফৌজদারি অপরাধের বিচার হওয়ার কথা সিভিল কোর্টে। তবে সামরিক আইনে বিচার করতে হলে ওই কোর্টের বিচারকের অনুমতি সাপেক্ষে তা সামরিক কোর্টে নিয়ে আসা যায়। এক্ষেত্রে দুইটি অপশনই রয়েছে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আগেই গ্রেফতারকৃত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান জুলাই-অগাস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেছিলেন। এ বছরের জানুয়ারিতে সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। আইনজীবীরা বলছেন, সেনা সদস্য বা কর্মকর্তাদের বিচার কোন আইনে করা যাবে সেটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘সাত খুন মামলা।‘
অর্থাৎ সেই ‘সাত খুন মামলা’র উদাহরণ টেনেই এখন এদের বিচার করা ও শাস্তি বিধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে ICT এবং এর প্রসিকিউটররা আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন।
এবার সেনাবাহিনীকে ছন্নছাড়া করতে চড়াও হলো সরকারের ICT. আর সেটা কোন সময়? যখন দেশ আন্তর্জাতিক একাধিক ষড়যন্ত্রে উপমহাদেশে যুদ্ধবাস্তবতা চলছে সে সময়। একদিকে পাকিস্তান TTP’র বিরুদ্ধে কাবুলে বিমান হামলা করে বোমা ফেলছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা ঢাকা-কক্সবাজার ট্যুর দিচ্ছেন। যখন চট্টগ্রামে মার্কিন গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ফিটজেরাল্ড বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাথে যৌথ নৌ-মহড়ার জন্য ৩২৭ জন ক্রু নিয়ে নোঙ্গর করেছে। যখন আবার স্থগিত পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর আলামত। যখন মিয়ানমার—ভারতের একাংশ-বাংলাদেশের একাংশ নিয়ে ‘বাফারজোন’ তৈরির ষড়যন্ত্র। যখন পশ্চিমা দেশগুলোতে ইউনূসের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ উঠছে, সেসময় এই ২৪ জন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল ICT.
এসব কিসের আলামত?
এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে বিগত দিনের অস্পষ্ট ডটগুলো মেলাতে শুরু করলে। গত বছর ৫ আগস্টের পর বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা যখন মাঠের দখল নিচ্ছিল, সেসময় জামাত একে একে দখল করেছে প্রশাসন, শিক্ষায়তন, পুলিশ, বিজিবি, সেনাদের একাংশ, সচিবালয়সহ ক্ষমতাবলয়ের ক্ষেত্রগুলো, এবং সেখানে দখল নিয়ে নিজেদের মতাদর্শের বাইরের সকলকে বিতাড়িত করেছে। এবার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে পারলেই তাদের এতদিনকার ‘আয়াতুল্লাহ খোমেনী মেথড’ কার্যকর করতে পারবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনীকে বিভিক্ত, শক্তিহীন, বিভ্রান্ত করে তাদের ওপরে ছড়ি ঘোরানোর জন্য ‘সশস্ত্র গণ মিলিশিয়া’ গঠন করা।
ডিজিএফআই-প্রাক্তন চিফ হামিদুল হক যিনি জামাতের পক্ষের লোক, সেই হামিদুল হক এবং জেনারেল ওয়াকার মিলে ২৪-এর ২ আগস্ট নিশ্চিত করেছিলেন যে সেনাবাহিনী আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাবেন না। তারা সরাসরিই ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এই দুজনসহ প্রায় সকল জেনারেলরা জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকার পরও এখন প্রতারিত বোধ করছেন কারণ, গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের হওয়া দুটি মামলায় তাদের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
১২টি দফতরে এই গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। সকল ৫৬ জন জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে বসেছেন। সকলেই তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর পেছনে ‘দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, সরকারের নির্দেশ অমান্য’ করে আন্দোলন দমনে ব্যবস্থা না নিয়ে আন্দোলনকারীদের জন্য ব্যারিকেড খুলে দিয়ে হাসিনাকে হঠানোর ‘পুরষ্কার’ হিসাবে সেইসব সেনা কর্মকর্তারা পেয়েছেন-সামরিক বাহিনীর ৪০ জন অফিসারের পাসপোর্ট বাতিল ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি। এরমধ্যে ১৮ জন সার্ভিং অফিসার, একজন বাদে বাকীরা সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান অফিসার। ২ জন নন-কমিশন্ড ওয়ারেন্ট অফিসার ও বাকিরা কমিশন্ড অফিসার। এছাড়াও পরিবারের সদস্য ৯জন, ২জন রাজনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ ৫১ জনের নামেই হত্যাসহ গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলাও করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা আমলের সেনা প্রধান ইকবাল করিম ভুঁইয়া। তিনি সম্প্রতি গুম কমিশনে গিয়ে সাক্ষ্যও দিয়ে এসেছিলেন। তিনি জোরালো দাবি জানিয়েছিলেন যেন গুম হওয়া ব্যক্তি, পরিবার ও অন্যান্য যারা এ বিষয়ে জ্ঞাত আছেন তারা যেন গুম কমিশনের কাছে সকল তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মকর্তাদের ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে বলেছেন। গত বছর জুলাইয়ে এই ইকবাল করিম ভুঁইয়া, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন (অবঃ) ও বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা উপদেষ্টারা রাজপথে আন্দোলনকারীদের উৎসাহ দিয়েছেন নিজেরা আন্দোলনকারী হিসাবে রাজপথে হাজির থেকেছেন।
মূল অভিযোগকারী এবং মূল সাক্ষ্য গোলাম আজম পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমী অন্যতম। তিনি বলেছেন-তাকে কয়েক বছর ধরে আয়নাঘরে গুম করে রেখে নির্যাতন করা হয়েছিল। এদের মধ্যে আরও আছেন সালাহউদ্দিন কাদের পুত্র হুম্মাম কাদের, মীর কাশেম আলীর পুত্র ব্যারিস্টার আরমান এবং ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা।
একদিকে এরা সকলে ভুক্তভোগী দাবী করে বিচার চাইছেন, আবার চাকরিরত সেনা কর্মকর্তারা প্রশাসনের আদেশে কর্তব্য পালন করার পর প্রিজনভ্যানে করে আদালতে বা জেলে যাবে? এটা ৫৬ জন জেনারেলের কেউই মানতে পারছেন না। ওয়াকার কাতরভাবে বলেছেন-‘আমি এসব ঠেকানোর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি’। তিনি আসলেই সবার কাছে গিয়েছেন, কিন্তু সরকারের কেউ তাকে আশ্বস্ত করেনি। তিনি এসব ভেবে নাকি অত্যন্ত বিমর্ষ।
এখন সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এধরণের ব্যবস্থা নিলে তাদের পক্ষে জুনিয়র অফিসারদের চেইন অব কমান্ড মেইনটেন করা সম্ভব হবে না। এসব ভেবে সেনা কর্মকর্তারা সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওয়াকারকে চাপ দিচ্ছেন, কেননা ওয়াকার কথা দিয়েছিলেন, তিনি মামলা যেন না হয় বা এই বিষয়টা যেন তামাদি করে রাখা যায় সেই চেষ্টা করবেন। ওয়াকার যে ব্যর্থ হয়েছেন বলাই বাহুল্য। এবার সেনা কর্মকর্তারা প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদেরও সেনা সদর দফতরে ডেকেছেন। তারা এখন ইউনূস সরকারের ওপর কোনও আস্থা রাখতে পারছে না। অর্থাৎ বর্তমান-সাবেক মিলিয়ে সেনা কর্মকর্তা আর ইউনূস সরকারের মুখোমুখি অবস্থা। এর আগেও একাধিকবার এমন হয়েছে, আবার উভয় পক্ষের চেষ্টায় আপোষরফাও হয়েছে, কিন্তু এবার সম্ভবত এসপার-ওসপার কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, যা ঠেকানোর ক্ষমতা কয়েকজন আইনজীবী, উপদেষ্টা এবং ছাত্রনেতাদের নেই।
ওয়াকার-উজ-জামান সবাইকে ‘খুশি করে সবার বিশ্বাসভাজন’ হতে গিয়ে একের পর এক আপোষ করতে চেয়েছেন। যাদেরকে ‘প্রটেক্ট’ করে গত চোদ্দ মাস ধরে নানা গঞ্জনা সয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন, সেই তারাই এখন তাকে ফেলে দিয়েছে জীবনের চরমতম পরীক্ষায়।
এরই মধ্যে রোববার জেনারেল ওয়াকার ‘সভা’ ডেকেছেন। হয়ত সেখানে তিনি কিছু একটা ‘ব্যালান্স’ করার চেষ্টা করবেন। তবে তিনি যে গত চোদ্দ মাসে এবারই ‘অগ্নিপরীক্ষায়’ পড়েছেন এতে কোনও সন্দেহ নেই।
সেনা অ্যাক্টের ৮ম অধ্যায়ে ৭৪ ধারায় বলা আছে ‘সেনাসদ্যদের বিচারের ট্রায়ালের জন্য গ্রেফতার করলে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে যথাপোযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে সোপর্দ করতে হবে। সেনা সদর বর্ণিত ‘হেফাজতে নেওয়া’ ১৫ জনকে আজ রোববারের মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে’। যদ্দুর মনে হচ্ছে তারা সেনা সদস্যদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে সেনানিবাসেই ‘অস্থায়ী কাস্টডি’ বা ‘সাব জেল’ করে তাদেরকে সেখানে রেখে বিচার করতে দিতে পারেন। তাতে করে হ্যান্ডকাফ পরে গ্রেফতার হওয়ার দৃশ্যটা এড়ানো যাবে।
গত বছর জুলাই-আগস্ট থেকে ‘আমরা ৫ আগস্ট পট পরিবর্তন না হলে গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলাম’ বলে যে হুমকিটি শোনা যাচ্ছিল একাধিক ছাত্র নেতা, উপদেষ্টা আর সমন্বয়কদের কণ্ঠে, তার আফটারম্যাথ এখন অনেকটা পরিষ্কার। কেন ঘন ঘন আইএসআই আসছে? কেন জাহাজে করে পাকিস্তানি-টার্কি উইপনস আসছে? কেন টার্কি-কাতার এদেশে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা করতে চাইছে? কেন দাগী জঙ্গিদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে? কেন ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার পেয়েও সেনারা মব থামানোর যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি, অথচ গোপালগঞ্জে ‘শত্রুদেশের মত’ ঝাঁপিয়ে পড়ে গুলি করেছে…… এখন কি ডটগুলো মিলতে চলেছে?




