সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগ সেজে মিছিল করায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত ১৬ জুলাই অর্থাৎ গোপালগঞ্জে এনসিপি-আওয়ামী লীগ সংঘর্ষের দিন গভীর রাতে ওই মিছিল করা হয় বলে জানা গেছে।
জানা যায়, রাতের আঁধারে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে মিছিল হয়। সাথে ছিল ’জামায়াত-শিবিরের চামড়া, খুলে নিব আমরা, বিএনপির চামড়া- খুলে নিব আমরা’ স্লোগানও। আর যারা স্লোগান দিচ্ছিলেন সবাই ছিলেন হেলমেট ও মাস্ক পরিহিত।
স্লোগান শুনে মনে হবে মিছিলটি বের করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু এর পেছনে ছিল নাটকীয় এক ঘটনা। মিছিলটির পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন দ্য রেড জুলাই সাতক্ষীরা জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেবহাটা উপজেলা শাখার আহ্বায়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজ এবং দেবহাটা উপজেলা জামায়াতের ইউনিট সদস্য সোলায়মান হোসেন।
আর দেবহাটা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে সখিপুর ইউনিয়নে নাটকীয় মিছিলটি সম্পন্নের পরামর্শক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। যিনি একসময় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকলেও, কয়েক বছর আগে জামায়াতের এক নারী নেত্রীর মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করে বনে গেছেন উপজেলা জামায়াতের ‘জামাতা’, তাদের ভোটব্যাঙ্ক কাজে লাগিয়ে হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান।
সমন্বয়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজে ও জামায়াত নেতা সোলায়মান হোসেনের নেতৃত্বে মিছিলটিতে অংশ নিয়েছিলেন তাদের অনুসারী কিছু ছাত্র প্রতিনিধি ও জামায়াতকর্মী।
ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুলের পরামর্শে ওই রাতে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের জনশূন্য চিনেডাঙ্গা এলাকায় মিছিলটি বের করেন সমন্বয়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজ ও জামায়াত নেতা সোলায়মান। অনেক পরিকল্পনা করে তারা নিজেরা মাথায় পরেছিলেন হেলমেট আর মাস্ক পরে ঢেকেছিলেন চেহারা। পাশাপাশি যাতে কেউ চিনতে না পারে সেজন্য মিছিলে অংশ নেয়া তাদের প্রত্যেক অনুসারীকেও মাস্ক পরিয়েছিলেন তারা। মুখে তোলেন ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জামায়াত-শিবিরের চামড়া, খুলে নিব আমরা’ ও ’বিএনপির চামড়া, খুলে নিব আমরা’ সহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্লোগান। কয়েক মিনিটের মিছিলটি অস্পষ্ট ভিডিওধারণ করে রাতেই নিজের আইডি থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার হুংকার দেন সমন্বয়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেবহাটাকে অশান্ত করে তোলা এবং পুলিশ প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে এলাকায় থাকা আওয়ামী লীগ কর্মীদের ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া।
মাঝরাতে মিছিলের অস্পষ্ট ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার পরই নড়ে চড়ে বসে দেবহাটা থানা পুলিশ, ঘুম হারাম হয়ে যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। উপজেলার বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারাও প্রথমে ফেসবুকে মিছিলটির অস্পষ্ট ভিডিও দেখে সেটিকে আওয়ামী লীগের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড ভেবে অবাক হয়েছিলেন।
এরইমধ্যে উপজেলা বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের হাতে পৌঁছায় পরিকল্পিত ওই মিছিলের স্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ, যা সেই রাতেই মোবাইলে ধারণ করেছিলেন সমন্বয়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজ ও জামায়াত নেতা সোলায়মান হোসেনের অনুসারীরা। আর এতেই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। মাথায় হেলমেট আর মুখে মাস্ক পরে চেহারা ঢাকার চেষ্টা করলেও, বেশভুষা দেখে সমন্বয়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজ ও জামায়াত নেতা সোলায়মানকে চিনে ফেলেন উপজেলা জামায়াতে ইসলামী ও সাতক্ষীরা জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। বিষয়টি আবারও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
বিষয়টি ঘিরে গত কয়েকদিনের আলোচনা-সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক মুজাহিদ বিন ফিরোজের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বুধবার (২৩ জুলাই) সংগঠনের প্যাডে দেয়া এক লিখিত আদেশে অপকর্মে লিপ্ত মুজাহিদ বিন ফিরোজকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাতক্ষীরা জেলা শাখার আহ্বায়ক মো. আরাফাত হোসেন।
উপজেলা জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মিছিলে হেলমেট পরে জামায়াত নেতা সোলায়মানের অংশগ্রহণের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। শুধু সোলায়মান নয়, তার সাথে ওই মিছিলে থাকা অন্যান্য জামায়াত কর্মীদের তালিকা করে এরইমধ্যে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাতক্ষীরা জেলার নেতৃবৃন্দকে সুপারিশসহ লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছেন দেবহাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মো. অলিউল ইসলাম।
এ নিয়ে গত কয়েকদিনে জেলা ও উপজেলায় দফায় দফায় বৈঠকেও বসেছিলেন জামায়াত নেতারা। যদিও অভিযুক্ত জামায়াত নেতা সোলায়মানসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এখনও কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলেও দাবি করেছেন উপজেলা জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা।