আওয়ামী লীগকে ‘পুনর্জন্ম’ দিয়েছে ৫ই আগস্ট

ধ্বংসোন্মুখ দলকে বাঁচিয়ে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগকে ‘পুনর্জন্ম’ দিয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা জীবিত অবস্থায় দেশ ত্যাগ করার কারণে দলটির এই পুনর্জন্ম হয়। কারণ এর আগে আওয়ামী লীগ নামেমাত্র রাজনৈতিক দল ছিল; দলের মধ্যে যেমন ছিল না ত্যাগী রাজনীতিবিদদের মূল্যায়ন, তেমনি দলটি হয়ে তীব্রমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছিল ডানে।

বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিতে আওয়ামী লীগকে ‘মুসলমান’ প্রমাণ দিতে হয়নি। বরং ইসলামবিদ্বেষী রাজনৈতিক দল—এই প্রচারণার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা ধরে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিকে তারা এগিয়ে নিয়ে গেছে। একাত্তরের মহাকাব্যিক মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের মুসলমান দেশগুলোর অধিকাংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বিজয়ের পথে, এবং অর্জন করেছে কাঙ্ক্ষিত বিজয়।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকেও মুসলমান দেশগুলো সহায়তা করেনি। তবু বাংলাদেশের দেশ গঠন ও অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। এর কারণ প্রগতিশীলতা। এই শব্দ কত ব্যাপক ও বিস্তৃত তার প্রমাণ আজকের এই বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেশে বৈধ-অবৈধ যত শাসক এসেছে, তারা ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়েছে। তারা সফল হয়নি দেশশাসনে। এটা হতে পারত আমাদের শিক্ষা, কিন্তু তা হয়নি। দেশ প্রবলভাবে এগিয়েছে ধর্মান্ধতার দিকে।

শেখ হাসিনার বিগত শাসনে বাংলাদেশ ছিল ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’। এটা ছিল বাহ্যিক উন্নয়ন। কিন্তু ভেতরটা আমাদের ধ্বংস হয়ে গেছে মূলত অপরাপর বৈধ-অবৈধ সকল শাসকের মতো অতি-ধার্মিকতায়। তাহাজ্জুদ পড়ে দিন শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী—এটা ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রকাশ্য বয়ান। একজনের মানুষের ব্যক্তিজীবনের অনুশীলন এমন হতেই পারে, কিন্তু এটা রাজনৈতিক প্রচারণায় যে অযাচিত, সেটা বুঝতে চেষ্টা করেনি আওয়ামী লীগ নেতারা। ৫ই আগস্টে গণভবন লুট হয়ে যাওয়ার সময়ে জায়নামাজ লুটের ঘটনাও বলছে শেখ হাসিনা ধর্মের আচার পালন করতেন। আগে যেমন ভাবতাম, এখনো তাই ভাবি—এগুলো ব্যক্তিক অনুশীলন।

আওয়ামী লীগের সর্বনাশের অন্যতম কারণ হচ্ছে ধর্মব্যবসায়ীদের আশকারা। আওয়ামী লীগের আমলে সরকার ধর্মের পরিচর্যায় যত অর্থ ব্যয় করেছে—এটা অন্য কোন সরকার করেনি। এখনো অনেক ধর্মীয় নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে তাদের মুখ থেকেই শোনা এটা আমার। তবে তারা জুলাই-আগস্টের অস্থিরতায় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।

এ-প্রসঙ্গ বাদ দিই; ফিরে আসি মূল কথায়। বলছিলাম—৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হয়েছে। এই দিনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত এবং তাদের শত শত লোক নিহতের পথ রচনা হলেও দলটির পুনর্জন্ম বলছি আমি। কারণ এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বেরিয়ে গেছে। যে অনুপ্রবেশকারীরা আওয়ামী লীগে ঢুকে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছিল, তারাও সরে গেছে। এখন এই মুহূর্তে যারাই আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে তারা শতভাগ নিবেদিত। এখন যারা আছে, তারা প্রগতিশীলতা ধারণ করে, তারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঁকড়ে ধরে। এখন যারা আছে, তারা দালালশ্রেণির নয়; কারণ যেখানে প্রাণের সংশয় সেখানে এই বিরূপ পরিস্থিতিতে দলকে সমর্থন করা দালালগোত্রীয়দের জন্যে অসম্ভব।

৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি হয়েছে ঠিক, কিন্তু দলটির সমর্থকেরা দল বদল করেনি, সমর্থন প্রত্যাহার করেনি। পনেরো মাস শেষে এখন এর প্রমাণ সারাদেশে নানাভাবে মিলছে। ‘মব’ কিছুটা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর এখন দলটির নেতাকর্মীরা নিজেরাও মব সৃষ্টির শক্তি অর্জন করে ফেলেছে।

আমি আমার আগের অনেক লেখায় একাধিকবার বলেছি—দেশকে ২০০৮ সালের পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে কথা থেকে সরে আসিনি এখনও। বরং আমার বলা কথাগুলোর সত্যতা মিলছে নানা ক্ষেত্রে। সে সময় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ঠেকাতে আওয়ামী লীগ না করা লোকজনেরা যেভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল, এখন সে পরিস্থিতি তৈরি হলো প্রায়। বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধী ইস্যু তাদেরকে এক কাতারে নিয়ে আসতে যাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে তত বেশি একাত্তর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনে দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগত করে রেখেছে আওয়ামী লীগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সময়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে অপরাধসম ভাবা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকে নিষিদ্ধ বস্তু রূপে মূল্যায়িত হচ্ছে যেখানে, সেখানে এটা আপনা থেকেই প্রমাণিত হতে যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যরা একাত্তরবিরোধী অপশক্তি অথবা এর সহযোগী।

শুরুর দিকে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলেছিল। এটা বলেছিল তারা জামায়াতকে কোণঠাসা করতে। অথচ সেদিন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসিমের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা নয়াদিগন্তের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম যে বক্তব্য দিয়ে এসেছেন, এটা মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের প্রতি অবমাননা। তিনি যুদ্ধাপরাধী মীর কাসিম, যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর নামোল্লেখ করে বলেছেন—তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ফখরুল ইসলামের এই বয়ান অনভিপ্রেত ও একাত্তরের ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করার শামিল। অথচ এই ফখরুল ইসলামকে আমরা সজ্জন ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিক বলে কত প্রশংসা করতাম। এখানে আমাদের যে ভুল ধারণা ছিল, সেটা ফখরুল ইসলাম তার বক্তব্যে প্রমাণ করে এসেছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। দখলদার স্বাভাবিকভাবেই পূর্বেকার সরকারের প্রতি আগ্রাসী হয়। তারাও এটা অনুসরণ করছে। এই পথে তারা আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর আঘাত করে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিয়ে জুলাই-আগস্টকে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছে। এটাই তাদের ভুল ছিল। এবং এটা এমনই এক ভুল, যে ভুলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথ রচনা হয়ে গেছে কিছু না করেই।

মহান মুক্তিযুদ্ধ এমনই এক অক্ষয় সত্তা, যার বিনাশ নাই। বরং কেউ যতবার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়াবে, ততবার দেশ মুক্তিযুদ্ধকে আগলে রাখবে। একাত্তরে ধর্মের দোহাই দিয়ে পার পায়নি হিংস্র পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘ, নেজামে ইসলামীসহ রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটির সদস্যরা। ত্রিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, তবু অর্জন করেছে বিজয়। এটা ইতিহাসের পাঠ ছিল। এই ইতিহাসের নিবিড় পাঠ জরুরি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের, কিন্তু তারা পাঠ করেছে পাকিস্তানিদের বয়ান। ফলে একাত্তরের পরিণতি অবধারিত তাদেরও। সরকার পাকিস্তানিদের বয়ান আত্মস্থ না করে যদি বাঙালির বয়ান আত্মস্থ ও অনুশীলন করত, তাহলে ক্ষমতা গ্রহণের পনেরো মাস শেষে এসে তাদের ‘এক্সিট প্ল্যান’ করতে হতো না। তারা বিনা প্রশ্নে থেকে যেত যতদিন ইচ্ছা, ততদিন। যদিও এটা অগণতান্ত্রিক, তবু দেশ বলত সেটাই।

পুনর্জন্মের যে কথা বলেছিলাম শুরুতে, সেখানে ফের দৃষ্টি দিই। অনুপ্রবেশকারী, প্রতিক্রিয়াশীল, ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট কালচারের দল পরিচালকেরা এখন আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছে। তারা মিশেছে বেশিরভাগ বর্তমান ক্ষমতাবানদের সঙ্গে। ফলে এই দুর্দিনে এখন যারা আওয়ামী লীগ করছে, তারা ত্যাগীর তকমাধারী। টানা ষোল বছরের দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের অনেকেই দুর্দিনের দল দেখেনি। ৫ই আগস্ট তাদেরকে সেটা দেখিয়েছে। এবং এটাই মূলত আওয়ামী লীগের ইতিহাস। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর হ ত্যাপরবর্তী একুশ বছর—এভাবেই প্রতিকূল পরিস্থিতি ছিল তাদের। এটাই কিন্তু তাদের ইতিহাস। এই সময়ের আওয়ামী লীগাররা আছে এখন সেই সময়ে, যা তারা কেবলই শুনেছিল।

আওয়ামী লীগকে নিয়ে দীর্ঘ এই লেখা দলটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের প্রতিফলন যদি ভাবেন, তবে ভুল ভাববেন। গত টানা চার আমলে লেখালেখি দিয়ে আমি যেখানে সমালোচনার দরকার সেখানে সমালোচনা করেছি; যেখানে প্রশংসার দরকার সেখানে করেছিল প্রশংসা। আগে একটা শ্রেণি আমার প্রতি রুষ্ট ছিলেন, এখন অন্য একটা শ্রেণি। আমার লেখালেখির সার্থকতা দেখি আমি এখানে। জুলাই-আগস্টের অস্থিরতার সময়ে আমার কিছু লেখা যেমন আন্দোলনকারীদের পক্ষে ছিল, তেমনি কিছু লেখা ছিল সরকারের পক্ষেও। যখন ঘটনা, তখনই সে রূপ প্রতিক্রিয়া আমার—এটাই আমার অনুশীলন। আমার অনুশীলনেকে প্রশংসা করল, আর কে নিন্দা করল—এটা দেখি কমই। আর দেখলেও, সে সবে প্রভাবিত হই সামান্যই। সুতরাং যা বলছি, সেটা আমার তাৎক্ষণিক এবং সময়ের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ। ঘটনা ও ঘটনার পরম্পরায় আমার বিশ্লেষণ বদলায়।

আপনারা কে কীভাবে ভাবেন জানি না, আমার কথা বলি—আমার কাছে বিশ্লেষণ অকাট্য বিশ্বাস নয়; আদর্শ তো কোনোভাবেই নয়।

Tags :

Kabir Aahmed

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025