আজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। এই দিনকে বুঝতে হলে একটু পিছিয়ে এসে আগস্ট মাসে আসতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালবেলা সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ও উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান একজন জুনিয়র সেনা অফিসার ডালিমের (বখাস্ত) পিছু পিছু রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রেসেডেন্টকে হত্যার খবর দেশবাসীকে জানাতে! পুরো একটা জাতিকে হাইকোর্ট দেখানোর এমন নজির পৃথিবীর আর কোন সেনাবাহিনীর ইতিহাসে নেই! পুরো একটা সেনাবাহিনী খুবই জুনিয়র ও গুটিকয়েক অফিসারের ভয়ে জিন্মি হয়েছিল এটা বিশ্বাস করতে হবে আমাদের? আমাদের জানতে হবে যে জেনারেল ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীত্ব চেয়ে পাননি বলে তিনি গোস্বা করেছিলেন। ওসমানী পরে খন্দকার মোস্তাকের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা উপদেষ্টা’ মন্ত্রী পদমর্যাদার পদটি উপহার পান।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের খুনি ডালিম ফারুক এরা সবাই ৪৬ বিগ্রেডের অধীনে ছিল যার প্রধান ছিলেন কর্ণেল শাফায়াত জামিল। বিস্ময়কর যে তিনি এই খুনি চক্রকে গ্রেফতার করেননি! কেন? কারণ তিনি ভয় পাচ্ছিলেন! এই কয়জন জুনিয়রকে ভয়? আসলে তা নয়। সেনাবাহিনী তখন সাবেক পাকিস্তান আদর্শে দীক্ষিত অফিসার ও বাম ঘরানার অফিসারদের বলয় মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, সোভিয়েত-ভারত ঘেঁষা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক সুরে কথা বলতে থাকে। এর প্রমাণ হচ্ছে জিয়া ও তাহের দুই মেরুর লোক ছিলেন। তাহের বাম, জিয়া প্রো-পাকিস্তান মাইন্ডের মডারেট ভার্সন। জিয়ার সঙ্গে খালেদ মোশাররফের ক্যারিয়ার নিয়ে জেলাসি ছিল। সেনাবাহিনীর আরেকটা বড় সমস্যা ছিল পাকিস্তান ফেরত অ-মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক কেউ-ই মুক্তিযুদ্ধ করেনি। রশিদ ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসে ও ফারুক ১২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যখন বুঝতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফারুক যুদ্ধের পুরোটা সময় ছুটিতে মধ্যাপাচ্যে ছিলো। যখন দেখলো পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার তখনই ১২ ডিসেম্বর যশোরে মেজর মঞ্জুরের অধিনে এসে যোগ দেয়। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন স্বাধীনতার পর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনীর কারা মুক্তিযোদ্ধা তার স্বীকৃতির দায়িত্বে ছিলেন। মেজর মইনুল ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি নানা দিক থেকে আসা চাপ সত্ত্বেও।
বিস্ময়কর যে সেনাবাহিনীর দন্ড বিধির আইনে ৩১ ধারা অনুযায়ী ১৫ আগস্টের খুনিদের তখনই গ্রেফতার করে কোর্টমার্শাল করার কথা। এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! এমনকি বেসমারিক কেউও যদি এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে থাকে তাকেও কোর্টমার্শালে বিচার করার কথা বলা আছে। কিন্তু খুনিরা সবাই সেনাসদরে ও বঙ্গভবনে অবাধে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
খন্দকার মোস্তাকের নিয়োগে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হলেন। শফিউল্লাহকে ন্যস্ত করো হলো পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে রাষ্ট্রদুত করার জন্য। পাকিস্তান ফেরত অমুক্তিযোদ্ধা জেনারেল এরশাদকে কয়েক ধাপ পদন্নতি দিয়ে একলাফে উপসেনাপ্রধান করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জার্মানিতে ছুটি কাটানো এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে অনিহা প্রকাশকারী তোয়াবকে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হলো। বিস্ময়কর যে এইসব নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল ডালিম ফারুক রশিদদের পরামর্শে! ফারুক বঙ্গভবনের একটা কালো মার্সিডিজে করে ঘুরে বেড়াতো। তাদের ক্ষমতার উত্স কোথায় এটা ভেবে সেনাবাহিনীর সত অফিসাররা বিস্মত হয়ে যেতো। সেপ্টেম্বর মাসে মোস্তাক ১৫ আগস্টের খুনিদের কোন রকম বিচার করা যাবে না বলে ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করে যা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে টিকিয়ে রাখে। এখানে বলে রাখা ভালো যে রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করে অথচ জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হয়েই নির্দেশ দেন দ্রুত রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে আত্মিকরণ করা হোক।
জিয়া মুজিব হত্যাকারীদের কোন রকম আয়ত্ব করার চেষ্টাই করেননি। তিনি ডালিম ফারুকদের পছন্দনীয় ছিলেন। ওদিকে জেনারেল ওসমানীর পছন্দ ছিল খালেদ মোশাররফ। কিন্তু মোস্তাক জিয়াকেই বেছে নেন সেনাপ্রধান হিসেবে। জিয়া ও খালেদ পরস্পরকে ঘৃণা করতেন।
খন্দকার মোস্তাক সরকারের জন্য সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সমর্থন একান্ত দরকার ছিল। মোস্তাক মূলত ডালিম রশিদদের বিদেশী প্রভুদের উপর নির্ভর ছিলো। ফলে বঙ্গভবনে এক চা চক্রে সিনিয়র অফিসারদের মোস্তাক নিমন্ত্রণ জানায় তাদের মনোভাব জানতে। শাফায়াত জামিল এই চা চক্রে যোগ দিতে ভয় পাচ্ছিল। তার ধারণা ছিল এর মাধ্যমে মোস্তাক তাদেরকে গ্রেফতার অথবা হত্যা করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা সেদিন একটা মেরুদ্বন্ড দেখানোর মত ঐতিহাসিক কাজ করেছিলেন জাতির জন্য। সিনিয়র অফিসাররা সেনা প্রধান জিয়াকে জানান বঙ্গভবনে যদি ডালিম ফারুক রশিদ এই চা চক্রে যোগ দেয় তাহলে তারা কেউ যাবেন না। জিয়া তাদের এই মতামত ওসমানীকে জানাতে বলেন। ওসমানী প্রেসিডেন্ট মোস্তাককে এই কথা জানানোর পর সিদ্ধান্ত হয় খুনিচক্র সেখানে উপস্থিত থাকবে না। এই ঘটনার পরই মোস্তাক আসলে তার পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে দেখতে পায়। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন লিখেছেন, তার দীর্ঘ সেনা জীবনে এমন থমথমে অস্বস্তিকর চা চক্র দেখেননি। কারোর সঙ্গে কেউ কথা বলেনি। অল্প সময়ের পরই কোন আলোচনা ছাড়াই সে চা পান অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়।
সেদিনই ডালিম রশিদ ফারুকদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর এই অস্থিরতা নিরসনে ব্যর্থতার জন্য শাফায়াত জামিল ও খালেদ মোশাররফ জিয়াকে দায়ী করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেন। এই রকম সময়েই চলে এলো ৩ নভেম্বর। বেগম খালেদা জিয়া একরাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেনকে ফোন দিয়ে বলেন, ভাই, জিয়াকে বেডরুম থেকে ধরে এনে ড্রয়িংরুমে এনে আটকে রেখেছে…।
খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়। এতে সেনাপ্রধান জিয়া বন্দী হন। মনোযোগী পাঠক খেয়াল করবেন, দেশে কিন্তু তখন কোন রাজনীতি নেই। যা খেলার সব সেনাবাহিনী খেলছে। খালেদ-জামিল অভ্যুত্থান সফল হলে পরবর্তী ইতিহাস কেমন হতো সেটা অন্য আলাপ। কিন্তু তারা অভ্যুত্থান না ঘটালে মুস্তাক সরকার নিয়ে বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যে এগিয়ে যেতো। কিন্তু তখনো সেনা অভ্যন্তরে অন্য খেলোয়াড়রা বসেছিল। এরা জাসদ। এরাই তুমুল ভারত বিরোধী বামপন্থী যারা খালেদ মোশাররফ ভারতের এজেন্ট হিসেবে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে বলে সেনা সদস্যদের ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ইতিহাস বলে বামেরা চিরকাল ইসলামী মাইন্ডের জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়ে নিজেদের চরম পরিণতি ডেকে আনে। এখানেও কর্ণেল তাহেরের কপালে সেটাই ঘটেছিল।
খালেদ-জামিল বঙ্গভবনে ডালিম ফারুক মোস্তাকদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পেনের বার্তা দিয়ে পাঠায়। ওসমানি সাহেব খালেদ মোশাররফকে ফোন করে বলেন, কোন মতেই যেন কোন রক্তপাত না ঘটে তাহলে দেশের সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে। খালেদ মোশাররফ ওসমানী সাহেবকে অনুরোধ করেন তিনি যেন ডালিমদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পনের আহ্বান জানান। অপরদিকে জিয়ার কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠানো হয় সই করে দেয়ার জন্য এবং জিয়া কথা মত সেটাই করে দেন। ডালিম ফারুক রশিদদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় তারা দেশ ছেড়ে কোন একটা দেশের উদ্দেশে চলে যাবে। ৩ নভেম্বর অভ্যত্থানের পর মোস্তাক ডালিম ফারুক এরা নিশ্চিত হয় খালেদ মোশাররফ হয়ত জেলে থাকা নজরুল ইসলাম তাজউদ্দিনদের মুক্তি দিয়ে নতুন সরকার গঠনের ব্যবস্থা নিবে। এই কারণে অতি গোপনে জেলখানায় এই চার জাতীয় নেতাদের ব্রাশ ফায়ার করে মারা হয়। ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত এই খবর গোপন রাখা হয়। অভ্যুত্থানকারীরা কিছুই জানতে পারেনি। রাতে ডালিম ফারুকরা দেশত্যাগের পরই এই নিউজ প্রকাশ করা হয়।
খালেদ মোশাররফ জিয়াকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হন। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পরই প্রকাশ্যে ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রথম মিছিল করে অভ্যত্থানকে সমর্থন করে। এই মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা নিজে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ যে চিরকাল দুটি ভাগে বিভক্ত সেটি স্পষ্ট একটি উদাহরণ এখানে আছে। বাংলাদেশের মানুষ নির্দিলীয়ভাবেও প্রচন্ড রকমের হিন্দু ও ভারত বিরোধী। দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে যাদের রাজনৈতিক উত্থান, ওহাবী ও ফারাজি যাদের ইতিহাস তাদেরকে খালেদ মোশাররফ ভারতের হয়ে অভ্যুত্থান করেছে রটিয়ে উত্তেজিত করা খুব সহজ। ফলে খালেদ মোশাররফকে কোণঠাসা করে ফেলা সহজ হয়েছিল। একাধিক সেনা অফিসার তাদের জবানে বলেছেন, এই অভ্যুত্থানে ভারত বা আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু বামপন্থীরা এটি খুব সফলভাবে রটাতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা বিরোধীরা এই রটনা গোটা দেশে সফলভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল।
খন্দকার মোস্তাক জাতীয় চার নেতা হত্যার জন্য সন্দেহাতীতভাবে দায়ী। তাকে রাষ্ট্রপতি রাখার প্রশ্নই আসে না। খালেদ মোশাররফ বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে তিনি সম্মতি জানান। ৬ নভেম্বর সায়েম শপথ নেন। খালেদ মোশাররফের ভুল ছিল তিনি ৭২ ঘন্টা পার হয়ে যাবার পরও জাতির উদ্দেশ্যে কোন ভাষণ দেননি। এতে গুজব রটতে সুবিধা পায়। তিনি অনেক বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। ব্যক্তিত্বের প্রখরতা দেখাতে পারেননি। ফলে তিনি আসলে কেবল তার নিজের নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসই অন্যভাবে লেখার জন্য একের পর এক ভুল করে যাচ্ছিলেন।
৩ থেকে ৬ নভেম্বর আসলে দেশে কোন সরকারই ছিল না! এটা খালেদ মোশাররফের ব্যর্থতা। এই সময়ে সেনানিবাসে লিফলেট বিলি করা হয় ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে। এটা ছিল জাসদের কাজ। তারা হুজব রটাতো। ভারত দেশ দখল করে ফেলেছে!
খালেদ মোশাররফের সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগে তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে এবং জিয়াকে অভ্যুত্থানকারী মুক্ত করে এনে তার নামে জিন্দাবাদ জানাতে থাকে। জিয়া মুক্ত হয়ে বাসায় বসেছিলেন। তখন কর্ণেল তাহের তাকে রেডিও স্টেশনে গিয়ে কিছু বলার জন্য অনুরোধ জানায়। কিন্তু অন্যরা জিয়াকে রেডিওতে যেতে নিষেধ করে। কর্ণেল আমিনুল নামের একজনের সঙ্গে তখন তাহেরের তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। আমিনুল কর্ণেল তাহেরকে ‘ভারতের বি-টিম’ বলে অভিযুক্ত করে! এটাই ট্রাজিডি যে যারা খালেদ মোশাররফকে ভারতের এজেন্ট বলে প্রচার করেছে তারাই ভারতের দালাল বলে আখ্যা পেলো!
এই অভ্যুত্থান ছিল একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। খালেদ মোশাররফ ও কর্ণেল হায়দারকে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভেতরে হত্যা করা হয়। সেদিন থেকে মূলত জিয়াউর রহমানই দেশ পরিচালনা করছিলেন। বিচারপতি সায়েম ছিলেন ছায়া। কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের যারা খালেদ মোশাররফপন্থী বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী তাদেরকে সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর সেই রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ইতিহাস…।
আজকে ৭ নভেম্বর বিএনপি ও এন্টি-আওয়ামী লীগের জন্য ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ ও আওয়ামী লীগের কাছে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’। ঐতিহাসিক এই দিনটিতে আসলে কি ঘটেছিল সবটা মূল্যায়ন করলে এই দিনটি আসলে সামরিক বাহিনীর এই দেশের রাজনীতি ভোট গণতন্ত্রের উপর সামরিক উর্দি পরিয়ে দেয়ার দিন।




