৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশের ভেতরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী। সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার। ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী। পাকিস্তানের জঙ্গি বিমান প্রায় সবই শেষ। একের পর এক সামরিক ঘাঁটি দখল করছে মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হতে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া এবং ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের মতো একের পর এক এলাকা।
অন্যদিকে দেশের বাইরেও এদিন চলেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানকে নিয়ে আরেক যুদ্ধ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশসংক্রান্ত মার্কিন প্রস্তাবটি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে ভেস্তে যায়।
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য অপসারণের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের কাছে আহবান জানানো হয়েছিল ওই প্রস্তাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি প্রস্তাব আনে, যাতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন, যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান ঘটবে। এতে পোল্যান্ড সমর্থন করে এবং চীন ভেটো দেয়। ভোটদানে বিরত থাকে অন্যরা।
এদিন মুক্তিবাহিনী ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শেষ কয়েকটি ঘাঁটি দখল করে নেয়। যশোর সেক্টরে কোটচাঁদপুর দখল করে ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয় তারা। চলতি পথে অগ্রগতি ও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখে মিত্রবাহিনী।
এদিন পশুর নদীর মোহনায় পাকিস্তানি নৌবাহিনীর নাবিকরা ‘আনওয়ার বক্স’ নামের বাণিজ্যিক জাহাজে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ধরা পড়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ‘রাজপুতের’ হাতে।
সিলেট সেক্টরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ করে শত্রুর পাঁচটি বাংকার উড়িয়ে দেয় এবং ডজনখানেক যানবাহন ধ্বংস করে। বাংলাদেশের উন্মুক্ত আকাশে মিত্র বিমানবাহিনী অবাধে বিচরণ করতে থাকে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে হামলা চালানো হয়।
ঢাকার আকাশে চলে বিমানের ডগ-ফাইট। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভুলে দিনের বেলায় মানুষ বাড়ির ছাদে উঠে উপভোগ করে এই আকাশযুদ্ধ। সকালে এই ডগ-ফাইট চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। চট্টগ্রামে পাকিস্তান নৌবাহিনী ও যৌথ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলোর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়।
জামালপুরের বকশীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। রংপুরের পীরগঞ্জ, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, পঞ্চগড়ের বোদা, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, দর্শনা ও ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে।
এদিন মেজর জলিলের নেতৃত্বে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরা মুক্ত করার পর খুলনা অভিমুখে অগ্রসর হয়। ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী সিংহঝুলি থেকে ঝিকরগাছা মুক্ত করে। তারপর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী তিন দলে বিভক্ত হয়ে যশোর আক্রমণ করে। উত্তর দিকের দল যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক ধরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মধ্যবর্তী দলটি ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে চিতের বিল এলাকা দিয়ে অগ্রসর হয়। দক্ষিণ দিকে বেনাপোল-যশোর সড়কে অগ্রসর হয় অন্য একটি দল। মুক্তিবাহিনী কোটচাঁদপুরে যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে জংশন দখল করে রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি পাকিস্তানি বাহিনীকে পেছনে সরে আসতে নির্দেশ দেয়, কিন্তু তা আর সম্ভব ছিল না। কারণ যশোর-ঢাকা সড়ক মিত্রবাহিনীর দখলে চলে যায়। মধুমতী অতিক্রম করে মিত্রবাহিনীর একটি দল খুলনা এবং অন্য দল কুষ্টিয়ার দিকে অভিযান অব্যাহত রাখে। পাকিস্তানি নবম ডিভিশন যশোর সেনানিবাস ছেড়ে মাগুরার দিকে চলে যায়।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিতর্ক
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ‘৭১-এর দশ মাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এদিন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সম্পর্কে তৃতীয় প্রস্তাব পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান। এই প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সব ধরনের সামরিক তৎপরতা বন্ধের দাবি জানানো হয়, কিন্তু সৈন্য সরিয়ে আনার কথা বলা হয়নি। পরিষদে এ নিয়ে আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন ও সোমালিয়া আরো একটি প্রস্তাব আনে। প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণের কথা বলা হয়।
এদিন ভোরে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন বসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫টি রাষ্ট্রের অনুরোধে। পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা বিতর্কে অংশ নিতে পারলেও তাদের ভোটাধিকার থাকবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকেও বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব জানায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে এতে চীনের প্রতিনিধি ঘোরতর আপত্তি জানান।
সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব এ মালিক মার্কিন প্রস্তাবকে একপেশে ও গ্রহণ অযোগ্য বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, দোষীকে ছেড়ে নির্দোষের ওপর এই প্রস্তাবের দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ প্রস্তাবটি পেশ করে বলেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য পরিষদে বল প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করতে পারে না। পূর্ববঙ্গে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণ অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহী অভিযোগ করেন, পাকিস্তানকে টুকরা টুকরা করতে ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে।
ভারতের প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বলেন, বিষয়টি যথাযথ পটভূমিতে বিবেচনা করতে হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বিতর্কে যোগ দেওয়ার আহবান জানাতে হবে।
তথ্যসূত্র: ৭১-এর দশ মাস : রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ও বাংলাদেশের তারিখ : মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান




